অব্যাহত দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, চর জেগে ওঠাসহ নানা কারণে ৩০ বছরে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ কমেই চলেছে। দখলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ জড়িত। নদীর জায়গা অবৈধভাবে ইজারা দিয়ে এই সংকোচনে ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দরও। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে এখন পর্যন্ত নদীর প্রায় ২৫ একর জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে।
আদালতের নির্দেশ আছে, পাড়সহ নদীর জায়গা কোনোভাবেই ইজারা বা হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু এ নির্দেশ মানছে না বন্দর। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বন্দর কিছু সংস্থাকে নদীসংলগ্ন এলাকা ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি ইনকনট্রেড কনটেইনার ডিপোকে দিয়েছে ১৯ দশমিক ৬ একর জায়গা। আর ফিশারিঘাট নতুন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রকে দিয়েছে ৪ একর। জেলা প্রশাসন এ নিয়ে গত বছর প্রশ্ন তুলেছিল। তবে বন্দরের ভাষ্য, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার কর্ণফুলী নদীর দখলকৃত স্থাপনা এবং ইজারা দেওয়া স্থানগুলো ঘুরে দেখেন। তিনি এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে ইজারা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, নদীর জায়গা ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার কখনোই কারও ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, নদীর জায়গা কেউ লিজ বা হস্তান্তর করতে পারবে না। কিন্তু বন্দর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নদীর জায়গা ইজারা দিয়েছে অবৈধভাবে। জেলা প্রশাসনও দিয়েছে। এতে সংকুচিত হচ্ছে কর্ণফুলীর গতিপথ।
চট্টগ্রাম নগরের ব্রিজঘাট এলাকায় ১৯৯০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। এই ঘাটের কাছাকাছি চাক্তাই এলাকায় ২০০৬ সালে শুরু হয় শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর নির্মাণকাজ। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি, পাকা অবকাঠামোসহ নানা স্থাপনা গড়ে ওঠে। তারও ছয় বছর আগে নদীর জায়গা ইজারা দেওয়া হয় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র তৈরির জন্য। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ কমে হয়েছে প্রায় ৫১০ মিটার।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গত আগস্ট মাসে শাহ আমানত তৃতীয় সেতু থেকে শুরু করে ফিরিঙ্গী বাজার মনোহরখালী খাল পর্যন্ত একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় নদীটির প্রস্থ ৫১০ মিটার আর ভাটার সময় ৪১০ মিটার। ২০১৪ সালে এডিবির পরিমাপ অনুযায়ী, সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে প্রস্থ ছিল ৮৯৮ মিটার, পরে কমে হয়েছে ৪৩৬ মিটার।
গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়েছিল। দুই দফা উচ্ছেদ অভিযানে সদরঘাট ও পতেঙ্গা লালদিয়ার চর এলাকায় প্রায় ৪০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। এরপর ১৩ মাস ধরে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন এ নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে। আদালতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রিট তো আছেই। ফলে উদ্ধার করা জায়গা নতুন করে দখল করতে কারও বেগ পেতে হয়নি। আদালতের নির্দেশের তিন বছর পর গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। এরপর থেমে থেমে চলে অভিযান। পরে উচ্চ আদালতের আরেক নির্দেশনায় চট্টগ্রাম বন্দরকে উচ্ছেদের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতাও নিতে বলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব বলেন, করোনার কারণে একটা স্থবির অবস্থা ছিল। এখন উচ্ছেদ কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। অতীতে অনেক উদাসীনতা ছিল নদীরক্ষা ও অবৈধ দখল উচ্ছেদে। কিন্তু কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে প্রশাসনকে অবশ্যই শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।
মতামত সম্পাদকীয়