অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে বলা হয়েছে, নগরীর ৩৬টি খাল ও নালা দিয়ে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নগরীর ৫২টি খাল ও নালার মুখ রয়েছে কর্ণফুলী নদীর অভিমুখে। এর অনেকগুলো দখল ও দূষণে ভরাট হয়ে গেছে। ৩৬টির মোটামুটি অস্তিত্ব রয়েছে। যেগুলো দিয়ে হরদম বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। এছাড়া নদীর দুই পাড়ের তিন শতাধিক কারখানা নিয়মিত নদী দূষণ করছে। এদের অনেকেই নদী ভরাটের সাথেও জড়িত। নগরীর ৭০ লক্ষ মানুষের বর্জ্য, পলিথিন কর্ণফুলীর তলদেশে বিশাল পলিথিন পাহাড় তৈরি করছে; যা নদী এবং নদীর জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
এ কথাগুলো নতুন নয়। দেখা যাবে, প্রতিমাসে কোনো না কোনো সংবাদমাধ্যমে কর্ণফুলীর দখল-দূষণ নিয়ে লেখা হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না।
দশ বছর আগে ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতু এলাকা ও চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯শ মিটার। এখন নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ থেকে ৫১০ মিটারে। নদীর দুই পাড়ে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে দখলদারিত্ব। নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে নানা স্থাপনা, অবকাঠামো। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহ। যাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের শঙ্কা যেমন জোরালো হচ্ছে তেমনি নদীর কিছু অংশ মরে যাচ্ছে। নদীতীরে চর জেগে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলছে।
নগরীর প্রতিটি খালের মুখ থেকে নদীর গভীর পর্যন্ত ময়লার বিশাল ভাগাড়। যা স্রোতের টানে নদীর আরো গভীর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। ভরাট হচ্ছে নদী, সাগর। যা ক্রমে সাগরের উচ্চতা বাড়িয়ে পুরো নগরীকে হুমকির মুখে ফেলছে। গৃহস্থালি, শিল্প ও বাণিজ্যিক বর্জ্যের মধ্যে কিছু বর্জ্য খালে বা নদীতে পচে গেলেও প্লাস্টিক এবং পলিথিন জাতীয় বর্জ্যগুলো নদীর সর্বনাশ করছে। বিশাল নগরীতে প্রতিদিনই যে ননুবায়োডিগ্রেডেবল (প্লাস্টিকুপলিথিন) বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তার একটি বড় অংশ খাল ও নালা হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর সাথে বন্দরে আসা কয়েক হাজার সমুদ্রগামী এবং লাইটারেজ জাহাজের বর্জ্যও সরাসরি পড়ছে নদীতে। জাহাজ থেকে নদীতে বর্জ্য ফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কেউ মানতে চায় না। ফলে শহরের বর্জ্যের সাথে বন্দরকেন্দ্রিক বর্জ্যের ধকল কর্ণফুলীকে সইতে হচ্ছে।
২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ কর্ণফুলী নদী শুধু চট্টগ্রামের প্রধান নদী নয়, এটি দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত। এ নদীতেই চট্টগ্রাম বন্দর। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এর নাব্যতার উপর নির্ভরশীল বন্দরের সার্বিক উৎপাদন এবং গতিশীলতা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটি দখলে দূষণে বিপর্যস্ত। নদীটি প্রতিনিয়ত ভরাট হচ্ছে, সরু হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের অপতৎপরতার পাশাপাশি নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে নদীর স্বাভাবিক গতি হুমকির মুখে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে ড্রেজিং করলেও নদী ধ্বংস ঠেকানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্যকে উৎসে আলাদা করা বাধ্যতামূলক করার কোনো বিকল্প নেই। বাসা, দোকান, হোটেল, ওয়ার্কশপের বর্জ্যকে সংগ্রহ করার আগেই পৃথক ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। সরাসরি বর্জ্য এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য এই দুই ভাগে বাছাই করার ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই কেবল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গতি পাবে। প্রতিটি উৎসে উপরোক্ত ব্যবস্থায় ময়লা ফেলা না হলে জরিমানা এবং যারা নিয়ম মানবে তাদেরকে পুরস্কৃত কিংবা রিবেট প্রদান করা হলে নদীমুখী বর্জ্য বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে। বিশেষ করে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যও যদি নদীমুখী গতি থেকে ফিরিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হিসেবে রিসাইকেল করা যায়, তাহলে সুফল মিলবে। এছাড়া নগরীর যে ৩৬টি খাল দিয়ে নদীতে বর্জ্য যায় সেসব খালের মুখে ‘গ্রিটুট্র্যাপ বা ট্র্যাশুবুম’ স্থাপন করলেও সুফল মিলবে। শিল্পে জিরো ডিসচার্জ ও রিয়েল টাইম মনিটরিং, ইটিপি মনিটরিং, রাতের বেলা ডিসচার্জ বন্ধে অনলাইন সেন্সরিংসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব আসবে। বন্দরে আসা জাহাজগুলোর ব্যাপারেও কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।
আগে না হয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের কারণে কর্ণফুলীকে দখল-দূষণমুক্ত করা যায়নি। কিন্তু এই ইন্টেরিম সরকারের আমলে সে কাজ করতে বাধা কোথায়?