বিবিসি বাংলা :
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন বা লাল, হলুদ ও সবুজ – এই তিন ভাগে ভাগ করে জোনভিত্তিক লকডাউন করার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
কোনো একটি এলাকার করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সংখ্যা ও সেসব এলাকায় সংক্রমণের ধরণ বিবেচনা করে এই জোন ভাগ করার চিন্তা ভাবনা চলছে বলে জানান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন।
লাল, হলুদ আর সবুজ – এই তিন জোনে ভাগ করা হবে বিভিন্ন এলাকাকে। একেক জোনের বাসিন্দাদের জন্য একেক রকম নিয়ম কানুন বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হলেও এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
মুশতাক হোসেন বলেন, “সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রেড জোন হবে, মাঝারিটা হবে ইয়েলো আর যেসব এলাকায় সংক্রমণ নেই বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংক্রমণ হয়েছে সেসব এলাকা থাকবে গ্রিন জোনে।”
মুশতাক হোসেন জানান সংখ্যাগত এবং গুণগতভাবে বিচার করে কোন এলাকা কোন জোনে রাখা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে গ্রিন জোনকে নিরাপদ হিসেবে ধরে নেয়া হলেও সেসব এলাকায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম না করা, অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়ার মত নিয়ম মেনে চলতে হবে মানুষকে।
রেড জোন
যেসব এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে সেগুলোতে কড়াভাবে লকডাউন কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান মুশতাক হোসেন।
তবে সুপারিশগুলো সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
রেড জোনে যেসব কোভিড-১৯ রোগী থাকবেন এবং যারা কোয়ারেন্টিনে থাকবেন, তাদের নিজেদের বাসা থেক বের হতে দেয়া হবে না।
আক্রান্ত রোগী ও কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের খাবার ও জরুরি ওষুধ তাদের বাসায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
“এর বাইরে এলাকাবাসী যারা থাকবেন তারা ঘর থেকে বের হয়ে জরুরি প্রয়োজনে দোকানে যেতে পারবেন, কিন্তু পালাক্রমে। একই সময়ে একসাথে বেশি মানুষ বের হতে পারবেন না। আর তাদের কেউ এলাকার বাইরে যেতে পারবেন না,” জানান মুশতাক হোসেন।
তবে সেসব এলাকায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, গ্যাস, বিদ্যুৎ বা গণমাধ্যম সেবার সাথে জড়িত জরুরি কর্মীদের বিশেষ অনুমতিপত্র থাকবে যেটি দেখিয়ে তারা এলাকায় যাওয়া আসা করতে পারবেন।
লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে এসব জরুরি সেবার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান মুশতাক হোসেন।
এলাকা লকডাউন করা হলেও এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়ার বড় রাস্তা লকডাউনের আওতায় থাকবে না বলে জানান তিনি।
”বড় বড় রাস্তা, যা অন্যান্য বাসিন্দারা ব্যবহার করবেন, সেটি বন্ধ করা হবে না। হয়তো চারদিকে রাস্তা আছে, তার মাঝখানের অংশটুকু বেষ্টনীর ভেতরে থাকবে। রাস্তার অপর পাশ হয়তো আরেকটি বেষ্টনীর ভেতর থাকবে।”
রেড জোনে থাকা এলাকাগুলোতে যারা ঘরে কোয়ারেন্টিন করতে পারবেন না, তাদের জন্য কমিউনিটি কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র করা হবে।
এছাড়া প্রত্যেকটি রেড জোনের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে একটি হাসপাতাল।
“এলাকার মধ্যে বা আশেপাশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থাকলে সেটিকে ঐ এলাকার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।”
এছাড়া রেড জোনের এলাকাগুলোতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জরুরি সেবার সাথে জড়িত অফিস ছাড়া অন্য কোনো ধরনের অফিস খোলা থাকবে না।
মুশতাক হোসেন জানান রেড জোনের লকডাউন কার্যকর করার খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
ইয়েলো জোন
মুশতাক হোসেন বলেন কোভিড-১৯ রোগী এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য রেড জোন আর ইয়েলো জোনের নিয়ম একই থাকবে।
তবে ইয়েলো জোনের আক্রান্ত না হওয়া বাসিন্দারা এলাকা থেকে বের হতে পারবেন বলে নিশ্চিত করেন তিনি। এছাড়া ইয়েলো জোনে হাসপাতাল, গ্যাস, বিদ্যুৎ সেবার অফিস ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু অফিস খুলে দেয়া হতে পারে। কিন্তু কোন অফিসগুলো খুলে দেয়া হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান মুশতাক হোসেন। এছাড়া এই এলাকাগুলোতে একসাথে অনেক মানুষ যেন প্রবেশ করতে বা বের না হতে পারেন, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এসব সিদ্ধান্ত?
বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন ঘোষণা করার পর তা কার্যকরভাবে পালন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় ও কমিউনিটি নেতৃত্বকে সংযুক্ত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন মুশতাক হোসেন।
“মানুষজন ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন মানছে কিনা তা নিশ্চিত করতে এবং কোয়োরেন্টিনে থাকাদের কাছে খাবার, ওষুধ পৌঁছে দিতে স্থানীয় ভলান্টিয়ার, সমাজ কল্যাণ সমিতি, হাউজিং সমিতির সদস্যদের যুক্ত করা হবে।”
কোয়ারেন্টিন করা ব্যক্তিদের তালিকা করা হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের স্থানীয় দোকানের সাথে সমন্বয় করে তাদের বাসায় খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেয়া হবে।
মুশতাক হোসেন বলেন, “এই ক্ষেত্রে আমরা টোলারবাগ মডেল অনুসরণ করবো। শুরুর দিকে টোলারবাগে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যখন, তখন এভাবে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।”
তিনি জানান প্রথমদিকে প্রত্যেক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজে প্রত্যেক জেলায় কমিটি ছিল, ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় সেরকম কমিটি তৈরি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। “সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে, আবার ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটিও থাকবে। আবার জোনভিত্তিক কমিটিও করা হতে পারে।”
বিভিন্ন জেলার কমিটিগুলোর আদলে তৈরি হলেও এসব কমিটিতে কীভাবে এনজিওসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে সংযুক্ত করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে জানান মুশতাক হোসেন। আর যারা এই পুরো কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকবে, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে জানান তিনি।