লিটন দাশ গুপ্ত :
২০১৯ সালের শেষ দিকের কথা। সম্ভবত অক্টোবর মাস ছিল। নিশ্চিন্তপুর গভীর অরণ্যে, পশুরাজ সিংহ এক জরুরি সভা ডেকেছিল। সভায় উপস্থিত ছিল বাঘ ভাল্লুক বানর শিয়াল ইন্দুর সহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি। আলোচ্যসূচি ছিল, নিশ্চিন্তপুর বনের সকল প্রাণি নিশ্চিন্তে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। কারণ এখন তাদের খাবার সংকট, আবাস সমস্যা আর সর্বদা ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। এই বনের অনেক প্রাণি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হবার পথে। আর এইসব হয়েছে দুইপা ওয়ালা’র কারণে। ‘দুইপা-ওয়ালা’ মানে মানুষ। এই মানুষকে ঠেকানোই বনে মিটিংয়ের আয়োজন।
গভীর রাতে নির্দিষ্ট দিনে সকল প্রাণির উপস্থিতিতে মিটিং শুরু হয়। মানুষের কারণে সৃষ্ট তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা, মঞ্চে এসে বলে যাচ্ছে একে একে বিভিন্ন প্রজাতি প্রাণির প্রতিনিধি। পশুরাজ সিংহ মনোযোগ সহকারে শুনছে। বিভিন্ন প্রাণির প্রদত্ত প্রস্তাব নোট করে নিচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ব্যাঙ, সাপ, মযূরসহ অনেক প্রাণি তাদের সমস্যার কথা বলেছে আর সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে গেছে। এরপর বক্তব্য দিতে এল বানর।
বানর প্রস্তাব দিল, সকল প্রাণি যার যার অবস্থানে থেকে, এক যোগে মানুষের উপর হামলা চালাতে হবে। মানে কেউ কামড় দেবে, কেউ আঁচড় দেবে, কেউ ফসল নষ্ট করবে, যাতে ‘দুইপা ওয়ালা’ মানুষ ভাতে মরে, পানিতে মরে, আর ধীরে ধীরে সংখ্যায় কমে আসে।
বাদুর বলছে ঠিক কথা ভাই, আগে আমরা বনের প্রাণি ছিলাম বেশি, দুইপা ওয়ালারা ছিল কম। এখন দুইপা ওয়ালারা বেড়ে গেল আমরা হয়েছি কম। তা হতে দেয়া যায়না। হৈচৈ পড়ে গেল, সবাই বলতে লাগলো ঠিক কথা। বাঘ বলে উঠলো, হালুম থাম যত সব বোকার দল। আমরা তো এইভাবে সবসময় হামলা চালিয়ে আসছি, পারছি তাদের সাথে? আমার জাতি ভাই মানে বাঘ, গত এক বছরে কয়টাকে পিটিয়ে মেরেছে খবর রাখো? এবার হাতি বলছে আমি গা গতরে সবার বড়। সেই হিসাবে বড় বড় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। দুইপা-ওয়ালার হাতে আমরা অনেক হাতি বন্দি হয়ে ক্রীতদাস হচ্ছি।
এইদিকে পিঁপড়ের সর্দার পিল পিল করে এসে বলল, আমার একটি প্রস্তাব আছে। আপনারা বড়রা সিদ্ধান্ত দিন আমরা যারা ছোট আছি যেমন মাছি মশা উই জাতীয় পতঙ্গরা সংখ্যায় বেশি। সবাই মিলে বাস্তবায়ন করবো। এই দিকে বনবিড়াল শুনে অট্টহাসি দিয়ে বলল, যেখানে হাতি মামা, বাঘ আঙ্কেল কিছুই করতে পারছেনা, তোমরা ছোট জীব দুইপা ওয়ালা’র একপায়ের নিচে চাপা পড়ে মরে যাবে কয়েক হাজার; এই বলে হেসে উঠল। এইদিকে পঙ্গপালের লিডার এসে বলল, আমাদেরকে ছোট বলবে না। আমরা এখন লক্ষ লক্ষ পতঙ্গ, দুইপাওয়ালার খাদ্যশস্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাবাড় করে দিচ্ছি। তাদের খাদ্যে কষ্ট দিচ্ছি খবরকি রাখো? এই অবস্থায় ছোট আর বড় প্রাণির মধ্যে শুরু হয়ে গেল তর্কবির্তক বাকবিত-া। বনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হৈচৈ।
এই দিকে বাঘডাস খরগোসকে বলছে যাকদে, আমরা বেঁচে গেছি; কারণ আমরা ব্যাঙের মত ছোট না, আবার সাপের মত লম্বা না, কিংবা হাতির মত বড় না। এই দিকে হৈচৈ এর মধ্যে বনের রাজা সিংহ গর্জন করে বলে উঠল, বড় ছোট নিয়ে হচ্ছেটা কী! মিটিংয়ে সবাইকে ডেকেছি আমি, ছোট কে বড় কে ঝগড়া করার জন্যে নাকি! ছোট দুইপা-ওয়ালা মানুষগুলো আমাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুইপাওয়ালা মানুষগুলো কি তোমাদের হাতি মামার চেয়ে বড়, নাকি বাঘ আঙ্কেল এর চেয়ে শক্তিশালী। তারা ছোট মাথায় বড় পৃথিবী জয় করে ফেলেছে। বুদ্ধি যার বেশি সেই হচ্ছে জগতের বড়। এই বলে ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে বলে, এবার প-িত মশাই থেকে কিছু শুনতে চাই। প-িত মানে শিয়াল, শেয়াল খুবই ধূর্ত বুদ্ধিমান প্রাণি। শিয়াল হাক্কাউয়া করে বলছে, মহারাজ আপনি ঠিকই বলেছেন যার বুদ্ধি বেশি সেই বড়। বুদ্ধি দিয়ে তাদেরকে হঠাৎ করে হঠাতে হবে।
আমাদের মধ্যে যারা ছোট জীব তাদেরকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এখানে আমি দুইপা ওয়ালাকে মারতে চাই ছোট জীব নয়, আরো ছোট ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র অণুজীব দিয়ে। সবাই বলে উঠলো কেমনে, কিভাবে, কি করে।
শেয়াল বলল, মানুষকে এক এলাকা থেকে হঠালে হবে না, পুরো পৃথিবীতে একযোগে হামলা চালাতে পারলে তাদের হঠানো সম্ভব হবে। বাঘ বলছে, কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বল, ধৈর্য ধরার দেরি করার সময় নাই। সিংহ বলছে, আহারে বাঘবাবু থামো; শিয়ালসাহেবকে বলতে দাও।
শেয়াল বলছে, পৃথিবীতে সব চেয়ে কোন দেশে মানুষ বেশি? কোকিল বলছে আমি সাড়া পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, আমি জানি চীন দেশে মানুষ বেশি। শেয়াল বলল, তাহলে আমরা চীনের কোন এক জায়গায় বাদুর বনরুই সজারু বা কচ্ছপকে দিয়ে সেখানে এক বিশেষ এলাকায় অনুজীব ছড়িয়ে দেব, তারপর সেখান থেকে তাদের দেশ আর পুরো দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে অনেক দুইপা-ওয়ালা মরতে মরতে, হয়ত একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমরা দুইপাওয়ালার ভয়ে ঘরে আছি, এখন তারা বাইরে। তখন দুইপাওয়ালা ভয়ে ঘরে ঢুকে যাবে, আমরা থাকবো বাইরে। সিংহ বলছে দারুণতো! বাঘ বলছে উত্তম প্রস্তাব। অন্যরা বলছে কী মজা কী মজা! এইদিকে বাদুর বনরুই বাদ সাধে।
তারা বলে আমরা যদি এই অণুজীব ছড়াতে গিয়ে ধরা পড়ে যাই, তাহলে ওরা পৃথিবী থেকে আমাদের পুরো বাদুর বা বনরুই জাতির বংশসহ ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। শেয়াল বলল, আমরা কয়েক জাতিকে দেব। এরা বুঝতে পারবে না কীভাবে ছড়িয়েছে। দুইপা ওয়ালা মানুষের মধ্যে এই নিয়ে ঝগড়া চলবে, কোথায় কোন দেশ থেকে এল এই অণুজীব। এই থেকে শুধু ঝগড়া বিবাদ নয়, এমনকি যুদ্ধও বেধে গিয়ে অনেক মানুষ মারা যেতে পারে।
এরপর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চীনের উহান প্রদেশে এই ভাইরাস ছড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয় বনরুই বাদুরসহ কয়েক প্রকার ছোট প্রাণিকে।
সভায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মৃত পশুর মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় উপস্থিত পশুপাখিদের। অতঃপর আলোচনায় আর বিশেষ কিছু বলার না থাকায়, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে পশুরাজ সিংহ সভা সমাপ্ত ঘোষণা করে।
সবাই শেয়াল প-িত মশাইয়ের জয় হোক বলে শ্লোগান দিতে থাকে। অবশেষে সিদ্ধান্ত মোতাবেক, বাদুর সজারু বনরুই’র সাহায্যে দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন করা হয়।
যার প্রেক্ষাপটে সাড়া পৃথিবীতে আজকে করোনা ভাইরাসের কারনে মানুষ জাতির এই অবস্থা।
এই অবস্থায় এবার মানুষের অর্থাৎ বনের জীবজন্তুর কথায়, দুইপা-ওয়ালা’দের করণীয় কী? এখন আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে, ভবিষ্যতে যাতে করোনার মত বনের পশুপাখিরা আরো বড় ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে।
এইজন্যে অরণ্য পশুপাখি প্রকৃতি পরিবেশ ইত্যাদির প্রতি মানুষকে সদয় হতে হবে। আগামীতে এমন দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল ভ্যাকসিন আবিষ্কার নয়, মানুষের পাশাপাশি মানুষকে পশুপাখি কীট পতক্সগ সবার কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে।