রাফে সাদনান আদেল »
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস থেকে আমরা এখনও পরিত্রাণ পাইনি। সারাবিশ্বেই এখনো কমেনি সংক্রমণের হার, থামেনি মৃত্যুর প্রকোপ। নতুন করে আবারো বাড়ছে সংক্রমণ। গুটি কয়েক উন্নত দেশে অনুমোদিত ভ্যাক্সিনের তুমুল প্রয়োগ শুরু হলেও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় হয় করছে। একদিকে ভ্যাক্সিন উৎপাদন বাড়ছে, অপরদিকে কমে গেছে সতর্কতা! কমেছে মাস্ক পরার হার, কমেছে হাত ধোওয়া আর স্যানিটাইজের অভ্যেসটাও। এমনকি টিকা নিয়েও প্রচলিত হাজারো গুজব, আছে টিকা গ্রহণেও নানাবিধ অনীহা!
এর মধ্যেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গিয়ে আমরা মরিয়া হয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি সেই স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকেই সেই প্রক্রিয়ায় জুড়ে দিয়েছে ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধি-নিষেধ। সরকার তো শক্তভাবেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ শ্লোগানে। কিন্তু ব্যক্তি আমরা কতোটা মানছি সেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কতোটাই বা মানতে পারছি। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হাজারো মিশ্র অনুভূতি আর কারণ চলে আসবে। আসলে এই করোনাভাইরাস জনিত সতর্কতাকে ঘিরে আমরা যা বলছি তার কতোটা গ্রহণ করছে সাধারণ মানুষ? আমাদের এই যোগাযোগ বা কমিউনিকেশনে কি কোনো খুঁত রয়ে যাচ্ছে? যোগাযোগের কৌশলেও কি আদৌ কোনো ঘাটতি থেকে যাচ্ছে?
খুব যদি ভুল করে না থাকি, করোনার মাঝামাঝি সময়ে নিউজিল্যান্ড একবার ঘোষণা দিল, তারা করোনামুক্ত, অন্তত এ মহামারির কোনো একটা সময়ে টানা দুই সপ্তাহ তাদের একজনও রোগী ধরা পড়েনি। আর সেই ঘোষণায় তারা স্পষ্ট করেই বলেছিল, এই স্বস্তির সংবাদের পেছনে তাদের মূল হাতিয়ারের অন্যতম ছিল ‘গুড কমিউনিকেশন’ তথা ভালো যোগাযোগ।
একটু যদি পেছনে ফিরে যাই, তাহলেই করোনার শুরুতে আমাদের যেটুকু ভীতির সঞ্চার হয়েছিল তা মূলত বহির্বিশ্বের করোনা সংক্রমণকে ঘিরেই। তাদের দুরবস্থায় আর আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে করতেই আমরা ধরাশায়ী ছিলাম। তার উপর যখন করোনাভাইরাস চলেই এল, তখন আইসোলেশন, লক-ডাউন, জোন লক-ডাউন এর মতো একের পর এক সিদ্ধান্ত আমাদেরকে আরো সক্রিয় করে তোলে সতর্কতায়। ওই সময়টুকুতেও আমাদের যতটুকু ভীতি ছিল যার ছিটেফোঁটাও আর এখন দেখা যাচ্ছে না। একটা সময় ছিল প্রতিদিনের পরিসংখ্যান দেখেও আমাদের মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও আমরা প্রতিদিনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রেখেছিলাম সেই পরিসংখ্যানকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর আমাদের জনস্বাস্থ্য থেকে প্রাপ্ত তথ্যই ছিল আমাদের সাধারণ মানুষের সাথে মূল কমিউনিকেশন বা যোগাযোগের উৎস। এর বাইরেও সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যার যার অবস্থান থেকে আমাদের প্রতিনিয়ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারাও এই দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়েই করোনা সতর্কতায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়াও একটা বড় ভূমিকায় ছিল গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণা। তথ্যের মান বিচারে এ উৎসগুলো দায়িত্বশীল থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল বড় বিড়ম্বনা। গুজব বলি আর অংসংলগ্ন তথ্যই বলি তার আখড়া ছিল এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। প্রয়োজনীয় ফিল্টারিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে এখানে অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে নানান তথ্য, আর সস্তা জনপ্রিয়তার স্বার্থে সেই তথ্যগুলোও গণ-মানুষের কাছে জায়গা করে নিয়েছে। তাই সঙ্গত কারণে একটা পর্যায়ে এই গুজব রোধেও কাজ করেছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো।
এমন দুর্যোগে উন্নত দেশগুলো কমিউনিকেশনেও সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছিল । কানাডা, আমেরিকাসহ কিছু কিছু দেশে তো কখনো রাষ্ট্রপ্রধান, কখনো তাদের দুর্যোগ মোকাবেলায় গঠিত টাস্কফোর্সের প্রধান নিজেই দিয়েছেন নিয়মিত দিক নির্দেশনা। প্রথম ঢেউয়ে একেবারেই আনকোরা এ মহামারি সামাল দিতে আমরাও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো হিমশিম খেয়েছি। কিন্তু এখন তো দ্বিতীয় ঢেউ পেরিয়ে তৃতীয় ঢেউ চলছে! এখনও কি একটা সমন্বিত কমিউনিকেশন সম্ভব নয়? কোভিড-১৯ সম্পর্কিত একটি শক্ত জনসচেতনতা গড়ে তুলতে এই যে সমন্বিত কমিউনিকেশনের কথা বলছি, তা গড়ে তোলা কতোটা কঠিন? সেই সক্ষমতায় আমরা কেন অসহায়?
আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি মোটেও কঠিন নয়। সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট মহল মনিটরিং করছে এ করোনা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত গবেষণা। এই গবেষণা আর মনিটরিং এর ফলাফলগুলো একটি নির্দিষ্ট বোর্ডে উপস্থাপিত হোক প্রতি সপ্তাহে। সেখান থেকে দেশের করোনা প্রবণতা ও তা রোধে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো জানানো হোক সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সেই বোর্ডে থাকুক করোনা মোকাবেলায় গেল ১ বছরে প্রথম সারিতে থেকে কাজ করেছে এমন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কমিউনিকেশনের কর্তা-ব্যক্তিরা। এমনকি গবেষক, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাও। তাদের দেওয়া দিক-নির্দেশনায় আমাদের কমিউনিকেশন পরিকল্পনাগুলো এক সুতায় গাঁথা হোক। অ্যাকশন প্ল্যানটা নিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান তাদের মতো করেই নিজ নিজ ক্রিয়েটিভে গড়ে তুলুক সচেতনতার নানান টুলকিট। প্রয়োজনীয় বাজেট যোগ কিংবা বণ্টনেও থাকুক সমন্বয়।
ধরুন, কোনো সপ্তাহে দেখা গেল আশঙ্কাজনকহারে কমছে মাস্ক পরার হার। তার পরের দুই সপ্তাহ চলুক মাস্ক পরার সচেতনতায় ক্যাম্পেইন। সব সংগঠন ঝাঁপিয়ে পড়ুক সেই আলোচনায়, মাঠে ঘাটে, গণমাধ্যমে আসুক সেই সতর্কতার সবটুকু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও থাকুক সেই আলোচনা। ইস্যু ধরে ধরে সময় বুঝে বুঝে এমন ক্যাম্পেইন না করায় যা হচ্ছে- তা হলো যে যার মতো নিজ নিজ প্রয়োজন আর স্বার্থ বুঝেই ক্যাম্পেইন করছে আর তাতে একই সাথে সব ধরনের তথ্য প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতো তথ্যের ভিড়ে গণমানুষ কোনো তথ্যেই আস্থা রাখতে পারছে না। এভাবেই করোনা প্রতিরোধের অভ্যেসগুলোর বাস্তবায়ন চলছে ঢিলেঢালাভাবে।
পৃথিবীতে আসা আর সব মহামারির চেয়ে করোনার সংক্রমণ প্রবণতা উদ্বেগজনক। তখন তো মানুষের কাছে পৌঁছুতে এতো মাধ্যম ছিল না। এই সময়ে ঘরে ঘরে নিজে গিয়ে সতর্কতার বার্তা না দিতে পারলেও আরো অনেক রাস্তা আছে। আমরা সেই রাস্তাগুলো ব্যবহারও করছি, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে, যে যার মতো। তাই চলমান গবেষণা আর মনিটরিংয়ের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত কমিউনিকেশন জরুরি।
একবার ভাবুন তো, আপনার চোখের সামনে থাকা সংবাদপত্র, টেলিভিশন কিংবা অনলাইনের পর্দায় আপনি টানা ২ কিংবা ৩ সপ্তাহ ধরে নানানভাবে শুধুই দেখলেন মাস্ক পরার সাতকাহন। আবার পরের সপ্তাহে হাত ধোয়ার আদ্যপান্ত, পরের সপ্তাহে কিভাবে ভ্যাক্সিন পাচ্ছেন তার সবটুকু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনে এমনকি বিজ্ঞাপনের পপ আপেও একই ধরনের আলোচনা। আপনার সড়কের বিলবোর্ডে, বড় বড় টেলিভিশনে, টক শো’য়ের তর্ক আর বিতর্কেও একই তথ্য টানা কয়েকটা দিন; তখনও কি আমাদের আর কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকবে? হুট করে আসা ভ্যাক্সিন রপ্তানি বন্ধের খবরে তখন কি আমাদের এভাবে তথ্যের জন্য এদিক সেদিক হাতড়ে বেড়াতে হবে? আমি বিশ্বাস করি, নিশ্চয়ই নয়। একটি তথ্য বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে একইসাথে।
তাই এ মুহূর্তে তথ্যকে ঘিরে তৈরি সব অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে সমন্বিত উদ্যোগের কোনোই বিকল্প দেখছি না। মেদহীন তথ্য পরিষ্কারভাবে একইসাথে সর্বত্র উপস্থাপন হলে কমে আসবে এ কমিউনিকেশন গ্যাপ! দুর্যোগে কমিউনিকেশন গ্যাপ যেন নতুন দুর্যোগ! আসুন তা এড়াতে আমরা গুরুত্ব দেই কৌশলগত সমন্বিত যোগাযোগ পরিকল্পনার দিকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক