সৌভিক চৌধুরী :
কবিতা এমন একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে কল্পনার রূপময়তা, ছন্দের ভাব এবং ঝংকার এক মিলিত দ্যোতনায় উৎসারিত হয়। বেশির ভাগ পাঠকই কবিতা উপভোগের যাত্রায় কিছুটা থমকে যান, কারণ কবিতার রসাস্বাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে আসলেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। মূলত ভাব ও রূপ মিলিত হয়ে যে-অখ- সত্তার উদ্বোধন হয়, তাকেই বলা চলে কবিতা। কবি এবং কবিতার অনুভূতিধারণের ক্ষমতা পাঠকের পক্ষে বুঝে ওঠা অনেক সময় দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ কবির প্রধানতম অনুভূতিগুলো রসের মাধ্যমে সৃষ্টি ও উৎসারিত হয়। এই রস বিষয়ের ঊর্ধ্বে। কখনোবা আবৃত্তিশিল্পী এক্ষেত্রে হতে পারেন প্রধান অবলম্বন। আসলেই কি তাই? পাঠক হয়তো কবিতাটি পড়লেন, কিন্তু কি পড়লেন। তিনি কতগুলো শব্দে গঠিত বাক্যের সাথে পরিচিত হলেন বটে, কিন্তু ঠিক বুঝলেন না যে, আসলে কবি কি বোঝাতে চাইলেন। এ ক্ষেত্রে কবি কি ব্যর্থ ? ঠিক তা নয়। কবি বললেন ভাবের কথা, অলংকারের কথা এবং ছন্দের কথাও। একজন আবৃত্তিকারও কবিতাটি পড়লেন, তিনি পড়লেন কবিতার ভাবসম্পদ এবং বুঝলেন সেই রসটাই। এই রসটা প্রকাশ করার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো শুদ্ধ উচ্চারণ, মাত্রা এবং উপস্থাপনার কলাকৌশল। তাই কবিতার অন্তর্নিহিত বক্তব্য আবৃত্তিকারের বোধগম্য হওয়াটা এক্ষত্রে অত্যন্ত জরুরি।
অনেকগুলো কবিতা পড়ার পাশাপাশি কোনো কবির কবিতার ডালি থেকে উৎকৃষ্ট কবিতাচয়ন করা আবৃত্তিকারের নিজস্ব ব্যাপার। কবি হয়তো অনেকগুলো ভালো কবিতাই লিখলেন, এটা তাঁর গুণাান্বিত বৈশিষ্ট্য। অসংখ্য আবৃত্তিকার এই কবিতাগুলো আবৃত্তির মাধ্যমে কবি ও কবিতার প্রসার ঘটান। কখনো কখনো এভাবে কোনো কবির একটি কবিতা বারবার পরিবেশনের ফলে এর একঘেঁয়েমিতাও প্রকাশ পেতে পারে। তবে এ কথা সত্য যে, কবিতার জনপ্রিয়তা ঘুরেফিরে আবৃত্তিযোগ্যতায় নির্ধারিত হয়। আধুনিক কবিদের কবিতা উপস্থাপনার ধারাবাহিকতায় এ রকমটি ঘটে স্বাভাবিকভাবেই, যা বহুলচর্চিত। এখন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তির পর্যায়ে একজন আবৃত্তিকারকে স্বরগ্রাম, আরোহণ-অবরোহণ, পরিশীলিত উচ্চারণ, সংযত আবেগ এবং বোধের বিষয়টিও আত্মস্থ করতে হয়।
‘কবি হিসেবে আমার কবিতাসৃষ্টি অনেকটাই আবৃত্তিনির্ভর’, সেটা রবীন্দ্রাথই বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি কিন্তু কবিতারচনার সময় আবৃত্তি করতে করতে লিখি, এমনকি যখন গদ্যরচনা ভালো করে লিখবো বলে মনে করি, এই গদ্য লিখতে লিখতেও আবৃত্তি করি। কারণ ধ্বনিসঙ্গতি ঠিক হল কিনা তার একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে কান।’ তাঁর এই উপলব্ধি এতোটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, শেষ পর্যন্ত তা আবৃত্তিকারকেই কবিতার নান্দনিক উপস্থাপনায় রসদ জুগিয়েছে।
আধুনিক কবিতার দীর্ঘ পথচলায় কবিতার ভাবটি কোনো সীমারেখার মধ্যে নির্দিষ্ট নয়। কারণ বহু দশক ধরে চলার পরিক্রমায় কবিতার রস এবং পরিপ্রেক্ষিত সমৃদ্ধ ও পরিবর্তিত হয়েছে। আবৃত্তিশিল্পী কখন-কিভাবে এর সঙ্গে পরিচিত হলেন তা তাঁর আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্যেই ফুটে উঠবে। কবিদের কাছ থেকে আমরা কবিতা পঠন-পাঠনের যে সুযোগ পেয়েছি, তা আবৃত্তিকারদের দক্ষতার মানদ-ে পরিশীলিতভাবে পরিবেশিত হচ্ছে, যা দর্শক-শ্রোতার জন্য একটি পরমপ্রাপ্তি বলা যায়।
বাক্যের শিল্পিত উচ্চারণই আবৃত্তি। শিল্পবোধসম্পন্ন একজন আবৃত্তিকার নিজস্ব গরিমায় কবিতার ভুবনে এমনভাবে বিচরণ করতে পারেন, যেন তিনি সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। অন্যদিকে কবিতারচনাই কবির শেষকথা নয়, এমন অনেক কবি আছেন যাঁরা নিজকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তির সগৌরব প্রয়াসের মাধ্যমে শ্রোতাসাধারণের মাঝে স্থান করে নেন। এই প্রয়াস কবির একান্ত নিজস্ব, যাকে স্বকীয়তা প্রকাশের ভিন্ন অভিব্যক্তি বলা যেতে পারে।
আমরা দেখেছি, যখন কবি তাঁর আবৃত্তির নিজস্ব চাহিদাপূরণ করেন, তখন তা আর নিছক কবির পাঠ থাকে না। এ যেন এক আবৃত্তিকারেরই আবৃত্তিকলা। এ অর্থে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তিকার, নজরুল আবৃত্তিকার, সুধীন্দ্রনাথ দত্তও আবৃত্তিকার। সেই অর্থে আবার বিষ্ণু দে ঠিক আবৃত্তিকার নন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুন্দর, শান্তকণ্ঠের পাঠ স্পষ্ট এবং অর্থবহ। কবিদের স্বরচিত কবিতার স্বকণ্ঠ উপস্থাপনা ভিন্নতর রূপ পায় যখন তিনি দেখেন তাঁরই কবিতা চেতনার জীবন্ত অভিব্যক্তি হয়ে শ্রোতাসাধারণের কাছে প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর মধ্যে হয়তো কণ্ঠের জাদু, উচ্চারণের স্পষ্টতা কিংবা আবেগের ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু এটা তো ঠিক যে কবি তাঁর নিজস্বতা এবং মৌলিকতা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি ।
কবিতার অনুষঙ্গ ছন্দকলা। কবিতাকে সমৃদ্ধ করে যে ছন্দ, তার নির্মাণকুশলতা একজন কবির জন্য অপরিহার্য। ছন্দনির্মিত কবিতা কবির অবস্থানকে দৃঢ় করে বিভিন্নভাবে। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, ‘কবিতার ছন্দকে ভাঙতে হয় ছন্দেরই প্রয়োজনে।’ আর আবৃত্তিকারকে তো ছন্দের কাছে আসতেই হয়। না এলে আবৃত্তিশিল্পের ষোলকলাপূর্ণ হতে পারে না। ছন্দবদ্ধ কবিতা নিয়ে আবৃত্তিকারের পথচলা এক প্রসন্ন দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়।
কবি কল্পনায় ছবি আঁকেন, তাঁর কবিতায় এক মোহময় ছন্দের ভাবরস বিকশিত হয়। এভাবে আবৃত্তির রূপময়তায় কবিতাটি যেন প্রাণময় হয়ে উঠল। কবি যখন কবিতা লিখলেন, তিনি তো সেটি পাঠকের জন্যই লিখলেন। এর প্রতিটি শব্দ যখন বাক্সময় হয়ে ওঠে, তখন দেখা যায়, কবিতার পাঠক যেন আর পাঠক থাকেন না, হয়ে ওঠেন সৌন্দর্য উদ্ভাসিত একজন সমঝদার। এটা সম্ভব হয় কেবল আবৃত্তিশিল্পীর নান্দনিক পরিবেশনার কারণে।
কবিতারচনা যেভাবেই হোক না কেন, এর আবৃত্তিযোগ্যতা নিরূপণ সহজ কাজ নয়। যেহেতু বেশির ভাগ কবি আবৃত্তির জন্য কবিতা লেখেন না, সেহেতু কবিতাটি কতটুকু উপস্থাপনযোগ্য, তার বস্তুনিষ্ঠতা আবৃত্তিশিল্পীকেই বের করে নিতে হয়। কবি এবং আবৃত্তিকারের মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়, তার অবলম্বন হল একমাত্র কবিতা।
একালের কবিতার অন্তর্নিহিত নির্যাস অনুধাবন করার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে আবৃত্তিকার তাঁর চেতনাকে শাণিত করতে পারেন। এর ফলে কবির কবিতাটি বাক্সময় হয়ে উঠতে পারে। আর এখানেই কবি, কবিতা এবং আবৃত্তিকারের প্রকৃত সফলতা।