আজির হাসিব :
এলিয়ট আবেগ এবং ব্যক্তিত্বকে কাব্য থেকে অপসারণের কথা বলেেেছন। অর্থাৎ তিনি ওয়ার্ডওয়ার্থের সঙ্গে এই জায়গায় পূর্ণ দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। এটা ঠিক, এলিয়টের যুগ তো আর রোমান্টিক যুগ ছিল না; তাই তিনি রোমান্টিক ধারাকে একবারে অপসারণ করতে চেয়েছেন। তিনি আবেগসর্বস্ব গীতিধারা থেকে আবেগনিরপেক্ষ নৈর্বব্যক্তিকতায় পৌঁছানোর কথা ব্যক্ত করেছেন। যে-আবেগসর্বস্ব রোমান্টিকতা আমরা বাংলা কাব্যের গীতিমাধুর্যে লক্ষ করি মহান কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে ওয়ার্ডওয়ার্থের মতোই। আর এর অপসারণ লক্ষ করি জীবনানন্দ ও তিরিশের কবিদের কাছে। কারণ তো আছেই। জীবনানন্দ কিংবা তিরিশি কবিরা তো টিএস এলিয়টের কাছ থেকেই আধুনিক কবিতার পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। এটাও তো ঠিক, নাগরিকজীবনে আবেগতাড়িত রোমিন্টকতার স্থান যে গৌণ এর প্রমাণ সমকালীন কবিতা কিংবা নাগরিকজীবন।
এছাড়া কবিতার মূল জায়গা যে জীবনবোধ কিংবা জীবনের পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা তা অনেকেই স্বীকার করে থাকেন। একজন নজরুল কিংবা নাজিম হিকমত সমাজ-রাষ্ট্রে শোষণ-নির্যাতন কিংবা বৈষম্য দেখেছেন বলেই কবিতায় ধ্বনি তুলেছেন প্রতিবাদ কিংবা দ্রোহের। কবিতার উৎসারণে এটিও একটি ধারা। যে ধারার কবিতা প্রকরণের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বিষয়ের প্রতি যতœশীল হয়ে ওঠে। এসব কবিতার বিষয় হয়ে থাকে সমাজ-রাষ্ট্রের অন্যায়, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কবিতার সুর ও স্বর উচ্চারিত হয়ে থাকে সাম্য ও শোষণহীন সমাজপ্রতিষ্ঠার উদ্যেশ্যে। এঁরা সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তন চান। ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে জাতি-রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে চান। বিভিন্ন কালে এসব কবিতা-গান সংগ্রামের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। এঁদের অধিকাংশ কবিই মার্কসের কাছ থেকে দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেছেন।
এরপরও কবিতার সুর ও স্বর সমকালকে স্পর্শ করে যায়। সমকালীন নানাবিধ দর্শনের ধারায় কবিতা প্রভাবিত হয়ে থাকে। জলের ঢেউ যেমন একটির ওপর অন্যটি স্পর্শ করে বিলীন হয়ে যায়, এবং অনিবার্যভাবে একটি ঢেউ অন্য ঢেউয়ের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যায়; তেমনি কবিতার সুর ও স্বর সমকালকে স্পর্শ করে। এজন্য এখন যদি কেউ মুধুসূদন দত্তের কবিতাকে অনুকরণ করে কবিতা রচনা করেন তাহলে অনেকে সেই কবিতা নিয়ে একটু হাসাহাসি করে থাকতে পারেন। কারণ, মধুসূদন কিংবা রবীন্দ্রনাথের কবিতার যুগ এখন আর নেই; সুতরাং তাদেরকে হুবহু অনুকরণ করলে সমকালে এটা আর কবিতার মর্যাদা পেতে পারে না। তাই বলে মধুসূদন কিংবা রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার কিংবা পাঠের অযোগ্য ভাবা যাবে না। কবিতারচর্চা করতে হলে এসব কবির কবিতা পাঠ করেই ভালো কবিতারচনার সিঁড়ি তৈরি করা যেতে পারে।
অবশ্য ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা কবিতাবিষয়ে চমৎকার একটি সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করেছিলেন, সেটা হলো : ‘বসন্তে পুরনো পাতার জায়গায় নতুন পাতা দেখা দিলে গোটা গাছটাকেই যেন মনে হয় নতুন, কাব্যের ক্ষেত্রেও সেই রকম কবির শব্দ ব্যবহারের কৌশলে ‘সর্বে নবা ইব ভান্তি’। কবিতাবিষয়ে তাত্ত্বিক হোরেস অনেক আগে বলে গেছেন দঅ ঢ়ড়বস রং ষরশব ধ ঢ়ধরহঃরহম. ফরাসি চিত্রকর শার্ল আলফাঁস দ্যু ফ্রেসনয় বলেছেন : দঅ ঢ়ড়বস রং ষরশব ধ ঢ়রপঃঁৎব ড়ঁমযঃ ঃড় ঃৎু ঃড় নব ষরশব ধ ঢ়ড়বসৃধ ঢ়রপঃঁৎব রং ড়ভঃবহ পধষষবফ ংরষবহঃ ঢ়ড়বঃৎু; ধহফ ঢ়ড়বঃৎু ধ ংঢ়বধশরহম ঢ়রপঃঁৎব.’
তাই কবিতার ভেতর যে চিত্র থাকে এটা সবারই জানা, চিত্র থেকেই কবির কল্পনা যোগ হয় বলেই বলা হয় চিত্রকল্প। আর এই চিত্রকল্পই কবিতায় ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে বলেই পুরনো পাতার জায়গায় নতুন পাতায় কবিতাবৃক্ষ ভরে ওঠে।
একজন চিত্রকর ছবি আঁকার আগে নিশ্চয়ই কল্পনা করে থাকেন, কল্পনার ভেতর তিনি যে অবয়ব দেখতে পান তা-ই রং-তুলি দিয়ে মূর্ত করে তুলেন। আর, একজন কবিও কল্পনা করেন, কল্পনার ভেতর যা ভাবেন সেই দৃশ্যকল্প তিনি শব্দদিয়ে গ্রন্থন করে যে একটি অবয়ব দেন তা কবিতার রূপ ধারণ করে। চিত্রকরের চিত্রের দিকে দর্শক যেমন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে; একজন কবির কবিতাপাঠ করেও পাঠক মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখনই একজন কবি যেমন সার্থক হন, তেমনি সত্যিকার কবিতারও জন্ম হয়। তবে যাঁরা কবি, যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের ভেতরে অপরিমেয় কল্পনাশক্তি থাকা চাই, নতুবা তিনি ভালো কবিতা লিখতে পারবেন না। কল্পনার পর তো ভাষাজ্ঞান হয়তো সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং একদিন প্রতিষ্ঠা পায়ও। তবে এটা ঠিক, কবিতা সব সময় সৃষ্টি হতে পারে না। কবির বিশেষ মুহূর্তের প্রজ্ঞাই কবিতায় রূপ নিয়ে থাকে। এটা সাগরের জোয়ারের মতই ফেনিল উন্মত্ততায় ভরপুর হয়ে ওঠে। একই কবির ক্ষেত্রে অন্য সময়ে ভাটার মতই ভালো কবিতা রচনা না-ও হতে পারে। কবিদের কবিতাচর্চায়ও বন্ধ্যা সময় যায়। কারণ, কবিতা সব সময় মনের গহিনে উঁকি না-ও দিতে পারে।
কবিতাকে একটি গোলাপের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাও আংশিক। গোলাপ বাগানে গোলাপ ফুটেছে, মানুষ বিমোহিত হচ্ছে। কবিতাও তাই। কবিতা পাঠ করে পাঠক বিমোহিত হন, অভিভূত হন কিংবা মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। কখনো পাঠক কবিতা পাঠ করে কবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে জেগে ওঠেন সংগ্রামী-দ্রোহী চেতনায়। তাই তো কবিতা অভ্যুত্থানও ঘটাতে সক্ষম, যদি সেটি সত্যিকারের কবিতা হয়ে ওঠে। পাঠকের এই সম্মোহন থেকে যায় যুগে-যুগে, কালে-কালে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কিংবা নজরুলের কবিতা এখনও পাঠক পাঠ করে থাকেন। আধুনিকতাবাদী কবিদের যুগে কিংবা উত্তরাধুনিকতার যুগেও তাঁদের কবিতার কদর কমেনি। গোলাপের সীমাবদ্ধতা হল এক সময় গোলাপ গাছ থেকে খসে পড়ে, বিনষ্ট হয়ে যায়। ভালো কবিতা খসে পড়ে না, নষ্ট হয় না, তা চিরকালীন। সমুদ্রতীরে পর্যটকেরা যেমন যুগে-যুগে, কালে-কালে দর্শন করে থাকেন। একটি বছর, একটি যুগ, একটি শতক কিংবা সহস্র বছর চলে গেলেও সমুদ্রতীর পুরাতন হয় না। পর্যটকের বদল হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সমুদ্র কিংবা সৈকত অবিকলভাবে প্রথম দিনের প্রেমিকাদর্শনের মতো যে আনন্দ দিয়ে যায় অনন্তকালÑ তা অফুরণযোগ্য। একটি ভালো কবিতাপাঠের আনন্দও একই রকম। একটি কবিতার জন্ম একটি হৃদয়সাগরেÑ যা প্রগলভা নারী কিংবা সমুদ্র সৈকতের মতোই হয়ে থাকে। (শেষাংশ)