এবার শিকার তানহা আক্তার মারিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
নগরীতে একের পর এক কন্যাশিশু হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রশাসনের কড়া নজরদারিতেও থামছে না শিশু অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা। শিশুর প্রতি একের পর এক এ ধরনের নিপীড়নের ঘটনায় উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। সর্বশেষ গতকাল রোববার ১৭ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁও থানার আওতাধীন সানোয়ারা আবাসিক এলাকায় নিজ বাসায় ঢুকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয় তানহা আক্তার মারিয়া নামের ৭ বছরের প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষাথীকে। এদিন সকাল সাড়ে ৮টায় এ ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করে চাঁন্দগাও থানা পুলিশ।
শিশু শিক্ষার্থী তানহা আক্তার মারিয়া লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার রামদয়াল এলাকার মো. বাকের হোসেনের কন্যা। তারা ওই এলাকার মৌলভী পুকুরপাড় চান্দের বাড়ির দিদার কলোনির ভাড়া বাসায় থাকেন।
তানহা হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রাকিবুল ইসলাম মুন্না (২৪) নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুন্না কক্সবাজার জেলার কক্সবাজার সদর থানার কক্সশাহীর টিকা এলাকার মৃত ইউসুফের ছেলে।
জানা যায়, নিহত তানহার পিতা পেশায় রিকশাচালক এবং মা গার্মেন্টসকর্মী । পেশাগত কারণে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে শিশুটিকে বাসায় একা থাকতে হতো। অন্যান্য দিনের মতো রোববার সকালেও শিশুটির বাবা-মা কাজে চলে গেলে শিশুটির ফুফু ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পান ঘরের মধ্যে এক ভবঘুরে ছেলেকে। একই সঙ্গে শিশু তানহার হাত-পা বাঁধা এবং পরনের পেন্ট নেই। ওই ভবঘুরে ছেলেটিকে ধাওয়া করেও স্থানীয় লোকজন ধরতে পারেনি। পরে ওই শিশুকে স্থানীয় এক হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এরপর শিশুটির পরিবারের সদস্যরা তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেও কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন শিশুটি বেঁচে নেই।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু তানহা হত্যার ঘটনায় জড়িত আসামি মুন্নাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের পর তাকে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। তার পরিবার হত্যা মামলা দায়েরের জন্য আবেদন করেছে। বর্তমান মামলাটি প্রক্রিয়াধীন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মুন্্না ধর্ষণের পর তানহাকে হত্যা করেছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। মামলার পর তাকে আগামীকাল (আজ) আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে।’
এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর নগরীর চাঁন্দগাও থানায় অপহরণ করা হয় তিন বছরের শিশু আবদুল্লাহকে। এ ঘটনার দুদিন পর তাকে নগরীর জিইসি এলাকা থেকে জীবিত উদ্ধার করে পুলিশ।
নির্যাতনের সব ঘটনা কন্যা শিশুকেন্দ্রিক
নগরীতে বারবার কন্যাশিশু হত্যার ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে নিপীড়নের শিকার শিশুদের অধিকাংশের বাবা-মা নিম্নআয়ের কর্মজীবী হওয়ায় এসব ঘটনা শ্রমজীবী মা-বাবার মনে বাড়তি আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। নিপীড়নের শিকার হওয়া প্রায় ঘটনার মূলে রয়েছে কন্যাশিশু। এসব ঘটনার সাথে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও জোরালো আইনি পদক্ষেপ না থাকায় দিনদিন এ ধরনের ঘটনার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছর ১৫ অক্টোবর নগরীর খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় খাবারের লোভ দেখিয়ে ৮ বছর বয়সী এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করে খাবার হোটেল মালিক নজির আহম্মদ। এ ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হলেও মামলাটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর ১০ দিন পর নগরীর জামালখান এলাকায় নিখোঁজ হয় ৭ বছর বয়সী মারজানা হক বর্ষা। নিখোঁজের ৩দিন পর একই এলাকার সিকদার হোটেলের পাশের নালা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মিন্টু নামের এক দোকান কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়। এর এক সপ্তাহ না পেরুতেই গত বছরের ২ নভেম্বর নগরীর আকবর শাহ থানার কর্নেল হাট জোন্স রোড এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় ৫ বছর বয়সী আরেক কন্যাশিশু। এ ঘটনায় আলমগীর খান নামে এক রিকশাচালককে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর একই বছরের ১৫ নভেম্বর নগরীর ইপিজেড এলাকায় বাসার পাশে আরবি পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় ৫ বছর বয়সী আলিনা ইসলাম আয়াত। ঘটনার ৯ দিন পর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আবির নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তিপণের জন্য আয়াতকে অপহরণের পর হত্যার স্বীকারোক্তি দেয় আবির। একই মাসের শেষ দিকে ২৭ নভেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানা এলাকায় বাসায় বাবা-মা না থাকার সুযোগে পৌনে ২ বছর বয়সী কন্যশিশুকে ধর্ষণ করে পার্শ্ববর্তী ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী দুলাল। এ সময় শিশুর ৭ বছর বয়সী ভাইকে কৌশলে দোকানে পাঠিয়ে দেয় অভিযুক্ত ব্যক্তি। পরদিন শিশুর মায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত দুলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর
২১ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী এলাকার বাসা থেকে আরবি পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয় ১০ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নী ওরফে আঁখি মনি। ঘটনার ৮ দিন পর একই এলাকা থেকে তার বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রুবেল নামে এক সবজিবিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
সমাজবিজ্ঞানী ও আইনি বিশ্লেষণে শিশুধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞানী ড. এ. এফ. ইমাম আলী বলেন, ‘পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও যৌন উদ্দীপনার মতো বিষয়গুলোর কারণে শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা ও হত্যার মতো অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধপ্রবণতা সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।’
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অপরাধীরা যৌননিপীড়নের জন্য সাধারণত শিশুদেরকে বেশি টার্গেট করে। কারণ শিশুরা যথাযথভাবে এসব ঘটনা তুলে ধরতে পারে না তার পরিবার ও সমাজের কাছে। ফলে বিষয়গুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছেও সুস্পষ্টভাবে ওঠে আসে না। তাই অপরাধীরা অনেক সময় পার পেয়ে যায়।’
চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী শিশুদের প্রতি অপরাধ ঠেকাতে আইনের পাশাপাশি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘মামলায় দীর্ঘসূত্রতা নেই তা বলা যাচ্ছে না। তবে আইনের সাথে জড়িতরা যে অবহেলা করছেন, তা নয়। স্বাভাবিকভাবে একটি মামলার ঘটনাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, সাজাটি সেভাবে প্রকাশিত হয় না।’
সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, একটি অপরাধের পেছনে বেশ কিছু ফ্যাক্ট থাকে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারে প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থলের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ থাকে না। সাক্ষীর অভাব থাকে। অনেক সময় ঘটনার শুরু আর তদন্তে প্রকৃত ঘটনায় ভিন্নতা দেখা যায়। একটি অপরাধ শতভাগ প্রমাণিত না হওয়ার আগে কাউকে দোষী বা অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না। এসব ফাঁকফোকর গলিয়ে অনেক সময় অপরাধী পার পেয়ে যায়। তাই এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।