বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সারা দেশে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে পঞ্চাশের বেশি মানুষ মারা যায়। তখন বলা হয়েছিল, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই সব ব্যক্তিরা ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে সরকারি দলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অপারেশন ক্লিন হার্ট ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনি বেড়ে যায়। যার প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠা করে। এর কিছুদিন পর থেকেই ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি আলোচিত হতে থাকে। তখন চরমপন্থী আখ্যা দিয়ে নিরীহ ব্যক্তিও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছিল। পরে পুলিশও ক্রসফায়ারে যুক্ত হয়।
২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে সারাদেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন হাজার ৮৮০ জন কথিত ক্রসফায়ারে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন। সেই হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পরই কার্যত সাময়িকভাবে থেমে গেছে ক্রসফায়ার। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মেজর সিনহার মৃত্যুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ কারণে আপাতত ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধ রাখা হয়েছে।
এর আগে জুলাই মাসে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৪৬ জন। মেজর সিনহা হত্যাকা-ের একদিন পর ২ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন আবদুল মান্নান মুন্না নামে এক যুবক।
এ ঘটনার পর গত ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ মাস দুইদিনের ব্যবধানে দেশের কোথাও ‘ক্রসফায়ার’ এর ঘটনা ঘটেনি। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানায় যোগ দেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার যোগদানের পর কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক পরিণত হয় ‘ক্রসফায়ার জোন’ হিসেবে। শুধু টেকনাফেই ওসি প্রদীপের (২২ মাসে) তার হাতে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় মারা গেছেন ২০৪ জন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভ সড়কে।
বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘও। ২০১৭ সালের ২৯ মার্চে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে। ঘটনার শিকার নাগরিকদের যথাযথ সহায়তা দিতে হবে। সরকারের উচিত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো।
মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সীমান্ত এলাকা টেকনাফেই বন্দুকযুদ্ধ তথা ক্রসফায়ারের ঘটনা বেশি ঘটেছে। দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবার প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ার পর সারা দেশে ইয়াবাবিরোধী অভিযান জোরদার করার দাবি ওঠে। সরকারের ওপর মহল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা হয়। তার অংশ হিসেবে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় ব্যাপক অভিযানে বহুলোকের মৃত্যু ঘটে। শুরুর দিকে এমন অভিযানের প্রতি জনসমর্থন থাকলেও কিছু কিছু ক্রসফারারের ঘটনায় জনমনে সন্দেহ দেখা দেয়। টেকনাফের যুবলীগ নেতা একরাম এবং সর্বশেষ মেজর সিনহার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধের দাবিতে দেশবাসী এখন সোচ্চার। এরকম ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বিশে^র কোথাও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাজেই সরকারকে এখন বিবেচনা করতে হবে এ ধরনের কর্মকা- ভবিষ্যতেও চলবে কি না । বরং মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার নতুন কোনো কৌশল ভেবে দেখতে পারে।