নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে জনসমক্ষে মারধর ও হয়রানির ঘটনায় এক ভুক্তভোগী মামলা করেছেন। এতে অজ্ঞাতনামা ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। বাদী প্রিয়া মনি নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের বলে পরিচয় দিয়েছেন। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলাটি করেছেন তিনি।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) মো. মসিউর রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ঘটনার পর মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে। এ প্রধান অভিযুক্তসহ অজ্ঞাত আরও পাঁচজনকে আসামি করে দেওয়া এজাহারটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ফারুকুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
সম্প্রতি কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে নারীদের হয়রানির তিনটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, একদল জনতা এক নারীকে কান ধরিয়ে ওঠবস করাচ্ছেন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুল ইসলাম।
ভিডিওর শুরুতে দেখা যায়, ফারুকুল ওই নারীর মুখের সামনে লাঠি তুলে তার বাড়ি কোথায়, বাড়ির নম্বর আছে কি নাসহ নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। এ সময় ভুক্তভোগীকে বারবার মাস্ক খুলতে বলা হয়। এ সময় পাশে থাকা আরেক নারী মেয়েটির মুখ থেকে মাস্ক টেনে খুলে ফেলেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হন। এ সময় কান ধরে ওঠবসের গণনা করছিলেন পাশে দাঁড়িয়ে কেউ।
ভাইরাল আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, এক দল যুবক সৈকতে পেতে রাখা বিচ চেয়ারে বসা এক নারীকে হয়রানি করছে। সেখানেও কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুলকে দেখা যায়। তারা ওই নারীকে ঘিরে ধরে তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন। একপর্যায়ে ওই নারীকে পেটানোর ভয় দেখিয়ে চেয়ার থেকে উঠে যেতে বাধ্য করা হয়।
এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘এখন পর্যন্ত কেলানি (মারধর) দিয়ে আসছি ওখান থেকে। সম্মানের সাথে উঠে চলে যান, না হলে কিন্তু অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। কেলানি খাবেন? দেন দেন শুরু করে দেন।’
তৃতীয় ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কাছে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হাতজোড় করে তার মোবাইল ফোনটি চাইছেন। সেই নারীকেও বহু মানুষ ঘিরে ধরে ছিলেন। যার মধ্যে ফারুকুলকেও দেখা যায়।
ওই নারী বার বার তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কাকুতি মিনতি করে বলেন, ‘আমার ফোনটা দিয়ে দেন। আমি আর কখনও আসব না কক্সবাজারে। যদি দেখেন, আপনারা পানিশমেন্ট দিয়েন। আমি এখনই টিকিট করে চলে যাব।’
অভিযুক্ত ফারুকুলের ফেসবুক পেজ থেকে এসব ভিডিও এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট স্ট্যাটাস পোস্ট করতে দেখা যায়।
ভুক্তভোগী প্রিয়া মনির করা মামলার এজাহারে এসব ঘটনা ১১ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছেন। বাদী নিজেসহ ভুক্তভোগী সবাই তৃতীয় লিঙ্গের বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
ভিডিওগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে ভিডিওফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে শুক্রবার রাতে কক্সবাজার শহরের ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্পসংলগ্ন এলাকা থেকে অভিযুক্ত ফারুকুলকে আটক করা হয় বলে জানান জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক জাবেদ মাহমুদ।
মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার চুনতি এলাকায়।
তিনি ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে সৈকতের উন্মুক্ত পরিবেশে ‘বেহায়াপনা আচরণের’ অভিযোগ তুলে এমনটি করেছেন বলে ভিডিও ফুটেজে বলতে শোনা যায়। তার ফেসবুক আইডিতে ১১ সেপ্টেম্বর শহরের লালদীঘির পাড় এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের লাঠিপেটা করার একটি ফুটেজ আপলোড করেছেন।
ডিবির পরিদর্শক জাবেদ মাহমুদ বলেন, সৈকতে মারধর ও নির্যাতনের কিছু ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্ত যুবককে শনাক্ত করা হয়। এরপর শুক্রবার রাতে শহরের ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্পসংলগ্ন এলাকা থেকে সদর থানা ও ডিবি পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে।
কক্সবাজার জোনের ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম বলেন, হেনস্থা শিকারের ভিডিও তিনটি তিনি দেখেছেন। এরপর খোঁজখবর নিয়ে তিনি জেনেছেন, ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে কিছু শিক্ষার্থী ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার সৈকতে ভ্রমণে আসেন। এ সময় তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজনকে মারধর করে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি অপরাধ।
ঘটনার সময় উপস্থিত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে পুলিশের অভিযানে আটক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ নন বলে দাবি করেছেন কক্সবাজারের স্থানীয় সমন্বয়কেরা।
সমন্বয়ক শাহেদুল ইসলাম শাহেদ বলেন, ‘আটক যুবক জেলার সমন্বয়ক বা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ নন। আন্দোলনে যেহেতু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশা, মত ও পথের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল; আটক যুবকেরও অংশগ্রহণ থাকতে পারে। তাই বলে তিনি সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না।’