প্রথম ট্রেনের হুইসেলে উচ্ছ্বসিত মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক »
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের মাটি ছুঁয়েছে রেলগাড়ি। প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল রুটের সফল অভিযান এটি। ছয়টি স্টেশন পরিদর্শন করে গতকাল (রোববার) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কক্সবাজারে পৌঁছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শন গাড়িটি। প্রথম ট্রেনকে পথে পথে স্বাগত জানিয়েছে স্থানীয় মানুষ। কোথাও কোথাও ট্রেনের উপর ফুল ছিটিয়ে বরণ করে নেয়া হয় নতুন এই রেল যাত্রাকে।
অবিভক্ত আসাম রেলওয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করে ১৯৩১ সালে। এরপর থেকে দোহাজারী স্টেশনটি বাংলাদেশের আখেরি (শেষ) স্টেশন নামে পরিচিতি পায়। ৯২ বছর পর প্রথমবারের মতো সেই আখেরি স্টেশন থেকে আরও ১০১ কিলোমিটার দূরে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পৌঁছেছে রেলগাড়িটি। ৭৮ টন ওজনের একটি ইঞ্জিনসহ আট বগি ছিল এতে।
গতকাল রোববার সকাল ৯টা দুই মিনিটে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে রেলগাড়িটি কক্সবাজার গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়। এর নেতৃত্বে ছিলেন রেলপথ পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদ। এ সময় পরিদর্শনের এই গাড়িটিকে ৯টি রেল স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট অতিক্রম করতে হয়েছে।
জানা যায়, পরিদর্শক দলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদসহ পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক, পরিবহন ও প্রকৌশল বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
রেল সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ার এক (১) ঘণ্টার মধ্যে কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করে দোহাজারী রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছার পর পরিদর্শক দল হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু স্টেশনে রেলগাড়ি থামিয়ে বিভিন্ন স্থানের রেললাইন, ইন্টারলকিং সিগন্যাল সিস্টেমসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে রেলগাড়িটি গতকাল রাতে চট্টগ্রাম ফিরে আসার কথা রয়েছে। কক্সবাজার রুটের প্রথম রেলগাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান লোকোমাস্টার মাহফুজুর রহমান ও সহকারী লোকোমাস্টার মো. রুকন মিয়া। এছাড়া, রেলগাড়িটি কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বে ছিলেন লোকোমাস্টার সাজু কুমার দাশ।
নিজের অনুুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে লোকোমাস্টার মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমবারের মতো একটা রুটে গাড়ি চালানো অনেক বিশাল ব্যাপার। আমি ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার নিয়ে এসে অনেক গর্ববোধ করছি। এ রুটে একেক জায়গায় একেক গতিতে যেতে হয়েছে। এরমধ্যে কালুরঘাট সেতুর উপর ১০ কিলোমিটার, চকরিয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার গতিতে রেলগাড়িটি চালাতে হয়।’
কক্সবাজারে প্রথম রেলে চড়ে যাওয়া সংবাদকর্মীদের মধ্যেও অন্যরকম স্বতঃস্ফূর্ততা কাজ করেছে। তাঁরা নিজেদের সেই অনুভূতির কথা তুলে ধরেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দোহাজারীর পর প্রথম ট্রেন চলাচল, হুইসেলের শব্দ শুনে স্থানীয়রা ছুটে আসে রেলগাড়িটিকে অভিবাদন জানাতে। স্টেশনগুলোতে যখন রেলগাড়িটি থেমেছে তখন কৌতুহলী অনেকেই তা ছুঁয়ে দেখেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পৌঁছে পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদ বলেন, ‘আমরা পুরো রুট বেশ সময় নিয়ে পরিদর্শন করে দেখেছি। পুরো রেলযাত্রা স্বাভাবিক ছিলো। এখানে রেলগাড়ি সব জায়গায় একই নিয়মে চালানো যাবে না। কোনো জায়গায় ৫০ কিলোমিটার, আবার কোনো জায়গায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে রেল চলবে। এসব বিষয়ে রেল প্রকৌশল বিভাগের কাছে নির্দেশনা রয়েছে। পরিদর্শনে সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় এ রেলরুট উদ্বোধনে কোনো সমস্যা হবে না।’
একই প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ নিয়ম হলো নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলে রেলপথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এটা তারই একটি অংশ।’
৪ নভেম্বর ২০০০ হর্সের বেশি ক্ষমতার ২৭০০ সিরিজের ৬৩ টন, ২৯০০ সিরিজের ৭৮ টন এবং ৩০০০ সিরিজের ৯০ টনের ইঞ্জিন পরীক্ষামূলকভাবে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে চালানো হয়। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, ‘সেতু সংস্কারকাজ ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াকওয়ে ও ঢালাইয়ের কাজ বাকি। তবে তা ট্রেন চলাচলের উপযোগী। বাকি কাজ শেষ হতে মাসখানেক সময় লাগবে।’
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার রেলরুট ও ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘প্রকল্পটির ৯৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চলাচলের কোনো সমস্যা নেই। ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর বাকি কাজ চলবে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের আগে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি পুনরায় সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাকি খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।
এ প্রকল্পে কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ১০১ কিলোমিটার রেললাইন ছাড়াও কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজরা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারীতে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘আইকনিক’ ঝিনুক আকৃতির কক্সবাজার রেলস্টেশন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর এই রেলরুট ও রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন। তবে এই রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ১ ডিসেম্বর থেকে।