ভূঁইয়া নজরুল :
করোনা আতঙ্কে পানিতে দ্বিগুণ মাত্রায় ক্লোরিন মেশাচ্ছে ওয়াসা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়তি ক্লোরিনযুক্ত পানি পান করলে শ্বাসকষ্ট, জন্মগত প্রতিবন্ধিতা মুত্রথলিতে ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার এবং শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর এই প্রভাব অনেক দেরিতে গিয়ে পড়বে। তাই উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া পানির মধ্যে হুট করেই ক্লোরিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যথোপযুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পানিতে দ্বিগুণ মাত্রায় ক্লোরিন মেশানো প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী প্রতিলিটার পানিতে শূন্য দশমিক পাঁচ মিলিগ্রাম ক্লোরিন মেশানোর নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সেই হিসেবে পানিশোধনাগার প্রকল্প এবং রিজার্ভারগুলোতে পানিতে ক্লোরিন মেশানোর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছি।’
কী পরিমাণ বাড়িয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে পানিশোধনাগার প্রকল্প এবং রিজার্ভারগুলোতে প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক পাঁচ মিলিগ্রাম মেশালেও এখন তা শূন্য দশমিক আট থেকে এক মিলিগ্রাম পর্যন্ত মেশানো হচ্ছে। এই ক্লোরিনযুক্ত পানি পাইপলাইন দিয়ে মানুষের ঘরে যেতে যেতে এর মাত্রা কমে আসে। আগে মানুষের ঘর পর্যন্ত প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক এক মিলিগ্রাম নিশ্চিত করলেও এখন তা শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কিন্তু পানিতে কেন এই ক্লোরিন মেশাচ্ছেন? এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওয়াসা সৃষ্টির পর থেকেই পানিতে ক্লোরিন মিশিয়ে তা সরবরাহ করা হয়। আগে প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক এক মিলিগ্রাম নিশ্চিত করতাম এখন তা শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম নিশ্চিত করছি। পানির মধ্যে থাকা যেকোনো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে এই ক্লোরিনের উপস্থিতি প্রয়োজন।
ক্লোরিনের মাত্রা কতটুকু হওয়া প্রয়োজন
বাংলাদেশের অবস্থার ক্ষেত্রে সুপেয় পানির ক্ষেত্রে পানিতে ক্লোনিরে উপস্থিতি কি কতো থাকা প্রয়োজন তা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ও প্রাক্তন সিনিয়ার কেমিস্ট জমির উদ্দিন বলেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী আমাদের দেশে সুপেয় পানির ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম ক্লোরিন মিশ্রিত অবস্থায় থাকতে পারবে।’
ওয়াসা মেশাচ্ছে কতটুকু
চট্টগ্রাম ওয়াসায় দীর্ঘদিন ধরে কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া অভিজ্ঞ কেমিস্ট মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ওয়াসা মূলত তিনটি ধাপে ক্লোরিন মিশিয়ে থাকে। প্রথমটি হলো নদী থেকে আসা পানির সাথে প্রথমে ক্লোরিন মিশিয়ে জীবাণুগুলো মেরে ফেলা হয়। পরবর্তীতে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া শেষে পাইপলাইনে প্রবেশের আগে একটি ট্যাংকে ক্লোরিন মেশানো হয়। আগে প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ক্লোরিন মেশানে হতো। তবে এখন তা বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৮ থেকে এক মিলিগ্রাম পর্যন্ত করা হয়েছে। এই পানি যখন কালুরঘাট বুস্টার, বাটালি হিল রিজার্ভার, নাসিরাবাদ রিজার্ভার ও পতেঙ্গা রিজার্ভারে যায় তখন আবারো ক্লোরিন মেশানো হয়। আর এতে মানুষের গৃহ পর্যন্ত সরবরাহ করা পানিতে ক্লোরিনের মাত্রা নিশ্চিত করা হয়।
তিনি আরো বলেন, পানিতে ক্লোরিনের উপস্থিতি থাকলেই জীবাণু মরে যায়। প্রথমে ব্যাকটেরিয়াজাত জীবাণু ও পরে ভাইরাস জীবানুগুলো ধ্বংস হয়। এজন্য প্ল্যান্টগুলোতে ক্লোরিন মিশিয়ে ৩০ মিনিট রাখা হয়।
বিশেষজ্ঞ বক্তব্য
পানিতে ক্লোরিন মেশানো প্রসঙ্গে সরকারি মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘মনে চাইলেই পানিতে ক্লোরিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া যায় না। পানিতে ক্লোরিনের মাত্রা বেড়ে গেলে পানির স্বাদ গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। একইসাথে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মাত্রার ক্লোরিনযুক্ত পানি ব্যবহারের ফলে হাফানি বা শ্বাসকষ্ট, ফুড পয়জনিং, জন্মগত প্রতিবন্ধিতা, মুত্রথলিতে ও কোলনে ক্যান্সার হয়ে থাকে। তাই উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া ক্লোরিনের মাত্রা বাড়ানো ঠিক নয়। এতে নগরবাসী দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’
অতিরিক্ত ক্লোরিন মেশানো প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘পানিতো করোনা ভাইরাসের জীবাণু থাকতে পারে সেই ধারণা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি লিটার পানিতে শূন্য দশমিক পাঁচ মিলিগ্রাম ক্লোরিন মেশাতে বলেছে। আমরা কোথাও কোথাও এক মিলিগ্রামও মেশাচ্ছি। কারণ পাইপ দিয়ে আসার সময় অনেক সময় ক্লোরিনের পরিমাণ কমে যায়। তাই বাসা পর্যন্ত সঠিক মাত্রায় (প্রতি লিটারে শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রাম) আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়। তবে আগে এই মাত্রা নিশ্চিত করা হতো শূন্য দশমিক এক মিলিগ্রাম। তা নিশ্চিত করতে রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে ২৪০টি পয়েন্ট থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
কিন্তু এর জন্য কোনো গবেষণা করা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গবেষণা করা হয়নি। যেহেতু কোভিড পরিস্থিতির কারণে বাড়াতে বলা হলো তাই ক্লোরিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ওয়াসা চাহিদার দুই তৃতীয়াংশ পানি সরবরাহ করছে। হালদা নদীর পানি পরিশোধন করে মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প ও মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প এবং কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্ল্যান্টে মেশানো হচ্ছে ক্লোরিন। একইসাথে কালুরঘাট বুস্টার, নাসিরাবাদ রিজার্ভার, বাটালি হিল রিজার্ভার ও পতেঙ্গা রিজার্ভারেও ক্লোরিন মেশানো হচ্ছে।
এ মুহূর্তের সংবাদ