সঞ্জয় দাশ »
(পর্ব-৮)
একটা মধ্যবয়সী মানুষ। রাত গভীর হতে থাকে ক্রমশ; চারদিক সুনসান। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় হট্টগোল পাকিয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে। এরপর শুধু অকথ্য ভাষায় চিৎকার চেঁচামেচি ; এক সময় তার হুশ থাকে না। ঘুমিয়ে পড়ে সোফায়। পরদিন সকালে দেখতে পায় সোফায় নয়, আসলে মেঝেতে উপুড় হয়ে আছেন তিনি। তাহলে রাতে কী হয়েছিলো লোকটার!
প্রায় সময় রাত-বিরাতে বাড়ি ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি করার একটা বাতিক লোকটাকে ক্রমে উন্মাদগ্রস্ততার একটা পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে কিছু মানুষের উৎসুক দৃষ্টি তার মাঝে কোনো বিকার তৈরি করে না। এমন কী হলো তার; যার জন্য রাতদুপুরে সশব্দে গাড়ি চালিয়ে এসে শুধু চিৎকার চেঁচামেচি; এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিছু না কিছু তো একটা আছেই। এমন অদ্ভুদ আচরণের মানুষ তার ফ্ল্যাটে থাকে এটা ভাবতেই কেমন যেন অস্বস্তি ভর করে। রোহিতের মনে হতে থাকে একটা মানুষের ভেতরেও তো আরেকটা মানুষের বসবাস থাকে। রাতদুপুরে চিৎকার চেঁচামেচি ঐ মানুুষটার ভেতরকার সত্তার প্রতিফলন নয়তো!
একটা ঘোরলাগা অনুভূতি নিয়ে রোহিত এগুতে থাকে সেই ফ্ল্যাটের দিকে। আলগোছে দরজা ভেজিয়ে রাখা রুমটার দিকে যেতেই চক্ষু চড়কগাছ। দরজায় গ্লাস লাগানো ছিদ্রের মধ্যে দেখা যায় ফ্লোরের মাঝখানে আস্ত একটা টেবিলে কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বিড় বিড় করে কী যেন একনাগাড়ে বলে চলছেন অদ্ভুদ দর্শন লোকটা।
কে? কে ওখানে ?
হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে বুকটা কেঁপে ওঠে তার। কী জবাব দেবে কূল পায় না সে। দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে যায় লোকটার।
আপনি কে? এভাবে এখানে কেনই বা দাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন।
লোকটার কথায় অনেকটা অপ্রস্তুত রোহিতের সম্বিৎ ফিরে আসে।
না মানে দেখছিলাম।
কি দেখছিলেন? এভাবে কাউকে ওয়াচ করা কি ঠিক?
আসলে রাতদুপুরে আপনার রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সমস্যা হচ্ছিলো; তাই কৌতুহলী হয়ে দেখতে এলাম আসলে হচ্ছেটা কী এখানে?
চিৎকার-চেঁচামেচি কে করলো?
এবার লোকটার কথায় কেমন আকাশ থেকে পড়লো রোহিত। বলে কী এ লোক!
আপনার রুম থেকেই বেশ জোরে চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। আশপাশের ফ্ল্যাটের কয়েকজনও একই কথা বললেন।
হঠাৎ শব্দ ক্ষীণ হতে লাগলো ঐ লোকের।
আসলে আমার স্ত্রী মারা গেছে। আমি একাই সব সামাল দিচ্ছিলাম। ও যে নেই তা মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর নাম ধরে ডাকছিলাম উচ্চস্বরে। আপনারা ঐ চিৎকারের শব্দই শুনেছেন।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
সেদিন ঐ ব্যক্তির রুমের সামনে থেকে আসার পর রোহিতের মনের ভেতর কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিলো মানুষের নিদারুণ অসহায়ত্ব নিয়ে।
নিবিষ্ট মনে অফিসে ফাইল দেখছিলেন রোহিত। বেশ কিছু কাজ জমে গেছে এর মধ্যে। হঠাৎ সেলফোনে আসা একটা ভিডিওক্লিপে চোখ পড়তেই দৃষ্টি থমকে গেলো। দীর্ঘক্ষণ খুচিয়ে খুচিয়ে দুই থেকে তিনটা ভিডিও ফুটেজ দেখলো সে। এর মধ্যে রয়েছে কিছু স্থির ছবিও। যতদূর চোখ যায় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাদা বরফের টুকরো। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি প্রাইভেট কার আর ওয়াগনও আছে। বরফের কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা চারপাশ জুড়ে খেলছে তিন থেকে চার জন। কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা বরফের মধ্যে খেলছে ওয়েলসের ছোট্ট মেয়েটি। তার হাতে বরফ কাটার একটা ছোট নিড়ানি। আপন মনেই বরফ নিয়ে খেলছে সে। মাঘের এমন শীতে দেশে তেমন একটা শীত না থাকলেও আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টোনে যেন বরফের মেলা জমে উঠেছে। বাচ্চাদের নিয়ে খেলায় মশগুল ওয়েলসও। ধবধবে সাদা একটা সুতি শাড়ির সাথে ফুলহাতা লালব্লাউজে ঢাকা ওয়েলসকে মনে হচ্ছে আসমান থেকে নেমে আসা এক অপ্সরী। অপ্সরীও হার মানবে তার সৌন্দর্যের কাছে। ঠোটে গাঢ় লাল লিপস্টিকে আবৃত এ অপ্সরীর অমন ভিডিও ক্লিপ দেখে মাথা ঠিক কাজ করছে না রোহিতের। এমন জীবন্ত এক দৃশ্য আর কখনো সে দেখেছে বলে ঠিক মনে পড়ছে না। কড়া এক কাপ ব্ল্যাক কফি খাওয়া খুব দরকার। পিওনকে ডেকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে আনতে বলে ফের খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকে ভিডিও ক্লিপগুলো। বহুদিন পর হঠাৎ কী হলো ওয়েলসের। এমন জমকালো ভিডিও আর তরতাজা কিছু ছবি পাঠালো সে। এর আগে অনেকবার অনুরোধ করলেও তার মন গলেনি। সে হয়তো জানে না, এটুকু ছবি-ভিডিও ক্লিপ দেখার পর একটা মানুষের মন কেমন ব্যাকুল হতে পারে। জীবনে চলার পথে আসতে পারে আশ্চর্যরকম ছন্দ।
স্যার আপনার কফি।
চোখ তুলে তাকাতেই পিয়নকে হঠাৎ ইচ্ছে হলো কিছু বখশিস দিতে। মনটা বহুদিন পর ফুরফুরে হয়ে গেলো নিমিষেই। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে; হয়তো যাদের সঙ্গ পাওয়া যায় না কিংবা কখনো তাদের সাথে পথচলাও হয়ে উঠবে না; এরপরও বাকি জীবন শুধু মুগ্ধতা নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। রোহিতের কাছে ওয়েলস এমন এক প্রতীতি; যার কোনো সঙ্গ দরকার হয় না; অথচ কী আশ্চর্য রকমের মুগ্ধতা! সেই ১৯৯৯ সালের দিকের কথা। কতই বা বয়স তার, হয়তো ২৪ কিংবা ২৫ আর ওয়েলস এর বড়জোড় ১৮ বছর। কী অপরূপ এক যাদুকরী সম্ভাষণে সে ছুটতো মেহেদীবাগের শেষ প্রান্তের একটা বাড়িতে। ঐ বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল টেপার আগে বুকটা কেঁপে উঠতো অজানা শংকায়…….ওয়েলস কি বাসায় থাকবে? খানিক বাদে দরজা খুলে যে মুখটা দেখতো রোহিত তার মধ্যে থাকত অপার বিস্ময়। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ সে বলতো ‘ভেতরে এসো’।
রোহিতকে মুগ্ধতার সম্ভাষণে খাবি খাইয়ে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য লাপাত্তা হয়ে যেতো সে। খানিক বাদে টেবিলভর্তি নানা জাতের বিস্কিট, চানাচুর, ফলফলাদির ট্রে নিয়ে তার সামনে রেখে বলতো, ‘খান’।
এরপর চলতো ঘণ্টাখানেকের আলোচনা। কখনো দুপুর গড়িয়ে গেলে তাকে ভাত না খাইয়ে ছাড়তো না ওয়েলস। ঘরভর্তি মানুষের মধ্যেও কোথাও যত্নের ত্রুটি থাকতো না। আজ কোথায় সেইসব সোনালী অতীত। কফি খেতে খেতে অতীত নিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকা রোহিতের সম্বিৎ ফিরে আসে হঠাৎ। এ যাপিত জীবন কাম্য নয়, তার শুধু ফিরতে ইচ্ছে করে আজ থেকে ২৪ বছর আগের কোন এক ভর সন্ধ্যায়, সেদিন দরজা খুলতেই ওয়েলসকে তার ভাইয়ের কথা না জিজ্ঞেস করে বলেছিল ‘আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্যই এখানে ছুটে আসি, তুমি কি বোঝ সেটা’।
চোখ আনত করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতো ওয়েলস। তখন সেই সন্ধ্যাকে মনে হতো আলোকচ্ছটা ছড়ানো বর্ণিল কোনো মুহূর্ত। আজ হয়তো বা সেই বর্ণিল সন্ধ্যা নেই। তবে এর প্রতীতি রয়েছে ঢের। রোহিতের বর্তমান বাসস্থান থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে থাকা সেই অপ্সরীকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দানা না বাঁধলেও তাকে ঘিরে থাকা সোনালী সময়ের ভাবালুতার অংশ হয়েই বাঁচতে চায় রোহিত। বেঁচে থাকার আয়োজন সে যতই পানসে হউক না কেন স্বপ্নময় অতীতের যে অফুরান রসদ তাতে কিছুটা স্বস্তি তো এনে দেয়। ছবি আর ভিডিও পাঠানোর জন্য ওয়েলসকে সাধুবাদ জানানো রোহিতের হুঁশ ফিরে আসে অফিসের জমে থাকা ফাইলের জট কবে খুলবে তা নিয়ে।
এদিকে গত দু’মাস ধরে প্রচণ্ড বরফ পড়ছে হিউস্টোনে। এ বরফের মধ্যেই সারতে হচ্ছে রাজ্যের কাজ। নিজের গড়া দাতব্য সংস্থার অনেক কাজ জমা হয়ে আছে ওয়েলস’রও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংস্থাটির কাজ শুরু করেছে সে। স্বদেশের কিছু স্বজন আর প্রতিবেশী মিলে গড়ে তোলা এ সংস্থাটির জন্য গত ১ মাস ধরে বেশ কিছু কাজ গুছিয়ে আনলেও নিজের দেশে এখনো পুরোদস্তুর কাজ শুরু করতে পারেনি সে। যথেষ্ট ফান্ড না থাকলে সব ঠিকমতো কুলিয়ে ওঠা যাবে না। তারপরও হাল ছাড়তে রাজী নয় সে। যেভাবেই হোক তাকে এগিয়ে যেতে হবে। মানুষের জন্য কিছু করার মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। এ ভাবনা থেকেই সংস্থাটির কাজ শুরু করেছিলো সে। মিলেছে যথেষ্ট সাড়াও। এমন উদ্যোগ ছিলো তার বাবারও। প্রতি বছর দুই ঈদে সামর্থ্য অনুযায়ী দুস্থদের মধ্যে অকাতরে দান করতেন তিনি। সকাল থেকেই থেকে থেকে শুধু বাবার কথাই মনে পড়তে লাগলো তার। হঠাৎ কিছু শপিং করা বাকী রয়ে গেছে এমনটি মনে আসতেই চটজলদি গাড়ি নিয়ে ছুটলো হিউস্টোনের সবচেয়ে বড় শপিংমলে। বড় বড় চারটি ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়ে যখন সে বাসায় ফিরলো তখন রাত বেড়েছে। বাসায় কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন মোরশেদ সাহেব।
কী ব্যাপার তুমি কখন এলে?
এইতো সন্ধ্যায়
আমাকে ফোন করলে না যে?
তুমি আছ তোমার কাজ নিয়ে। তোমাকে কী আর বিরক্ত করা যায়
তুমি খেয়েছো?
না
সেদিন খাওয়া শেষে একথা-ওকথার পর যখনই দাতব্য সংস্থার কাজ নিয়ে কথা উঠলো অমনি মোরশেদ সাহেব বলে উঠলেন
দ্যাখো আমি ওসবের মধ্যে নেই। কাজ নিয়ে এমনিতেই আমার গলদঘর্ম অবস্থা সেখানে আমার মনে হয় না তোমাকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবো। তুমি যদি চাও কিছু আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
তাও ভালো।
স্বামীর মুখে এমন সহযোগিতার কথা শুনে মনটা ভরে গেলো ওয়েলসের। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে তার ভাইয়ের সহযোগিতার প্রয়োজন হলেও তার সাড়া মিলছে না। তিনি আছেন তার নিজস্ব জগত নিয়ে। তবে আর কিছু না হোক, নিজের গড়া দাতব্য সংস্থার জন্য ইতিবাচক যে সাড়া মিলছে তাতেই সে খুব খুশি।
রাত প্রায় একটা। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ঘুমানোর সময় হঠাৎ সশব্দে বেজে উঠলো ফোন। চট্টগ্রাম থেকে তার বাল্যবন্ধু ডা. অনামিকা ফোন করেছে।
কিরে কেমন আছিস?
আছি একরকম। গৎবাঁধা জীবন, রোগী আর হাসপাতাল নিয়েই সময় চলে যাচ্ছে। নিজের কথা ভাবার ফুসরৎ নেই।
নিজেকেও তো দেখতে হবে, আর কতদিন এভাবে একাকী জীবন কাটিয়ে দিবি?
এইতো আমি বেশ ভালো আছি।
অনামিকা কি আসলেই ভালো আছে? প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতেই হঠাৎ ভেতরে কোথাও মোচড় দিয়ে উঠলো। বেচারির কেউ নেই। জীবনের এতোগুলো সময় পেরিয়ে গেছে, নিজের কথা কখনো ভাবেনি সে। তার জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। হঠাৎ রোহিতকে ফোন দিয়ে বসলো ওয়েলস।
কেমন আছ?
শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। একটা না একটা অসুখ লেগেই আছে।
ডাক্তার দেখাও। অসুখ নিয়ে চুপচাপ বসে থেকো না। এখন বয়স হচ্ছে। শোন তোমাকে দুটো কারণে ফোন করলাম। একটা হলো তোমার শারীরিক খবরাখবর আর আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর জন্য পাত্র দেখার বিষয় নিয়ে। আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যেই খবর জানাতে হবে।
ওহ্ তোমাকে খবর নিয়েই আমি জানাবো।
সেদিন ওয়েলসের ফোন আসার পর থেকেই রোহিতের কেবল একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘এ যুগে এসেও এমন পরোপকারী আর নিঃস্বার্থ মানুষ আছে!’ এটা নিয়ে ভাবনার যত গভীরে সে যাচ্ছে মনটা শ্রদ্ধায় ততই নত হচ্ছে ওয়েলসের প্রতি। পারিবারিক শিক্ষা আর জীবনবোধের গভীরে থাকা আত্মানুসন্ধানই তাকে এমন অনন্য গুণের অধিকারী করেছে। হঠাৎ ঢাউস সাইজের একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখতে ইচ্ছে হলো রোহিতের। সে ছুটলো শহরের সবচেয়ে পুরনো একটা স্টুডিওতে। ৮ ফুট / ১০ সাইজের একটা জমকালো ছবির অর্ডার দিয়ে পরদিনই তা ডেলিভারির ব্যবস্থার কথা জানিয়ে দিল স্টুডিও কর্তৃপক্ষকে। ছবিটা ওয়েলসের। হোয়াটস অ্যাপ থেকে প্রিন্ট নেওয়া সেই ছবির দিকে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলেন রোহিত। তার মনে হচ্ছে না ওয়েলস লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে। সে তো এখন তার সামনেই জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে।