সঞ্জয় দাশ »
সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না রোহিতের। নানা শারীরিক-মানসিক চাপ তাকে খুবলে ধরেছে বেশ কিছুদিন ধরে। ওয়েলসের সাথে বলতে গেলে তার কোনো যোগাযোগই নেই দীর্ঘদিন। সেই ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে অনলাইনে তার সাথে যোগাযোগ হয়েছিলো রোহিতের। তখন একটা ‘ভাইব’ ছিলো। এখন তা সুদূর পরাহত। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই সেদিন তার সারা শরীর-মনে পুলকিত আবরণ লেপ্টে ছিলো মানিপ্ল্যান্ট গাছের কাণ্ডের মতো। তার খুবই মনে আছে কোনো এক কথা প্রসঙ্গে ওয়েলস তাকে বলেছিলো তোমার যদি ইচ্ছে না হয় আমাকে ফোন করো না। যোগাযোগ না রাখলেও আমি অবাক হবো না। এখন মনে হচ্ছে তার কথাই সত্যি। আসলেই তো; যোগাযোগ না থাকলেও কারো কিছু এসে যায় না। তবে কখনো-সখনো পুরনো স্মৃতিগুলো যখন খুবলে ধরতে চায়; তখন কিছু করার থাকে না। ইচ্ছে হয় তার সাথে ফোনে জমিয়ে আড্ডা দেয়ার। কিন্তু এক পর্যায়ে ইচ্ছেটা ফিকে হতে শুরু করে। আর ইচ্ছেটা ফিকে হতে শুরু করলে পৃথিবীর তাবৎ সবকিছুর প্রতি মোহহীনতার আবেশ তৈরি হয়। দীর্ঘসময় ধরে ওয়েলসকে নিয়ে আবর্তিত রোহিতও মোহাবিষ্টের ইন্দ্রজাল ছিড়ে এখন মৌনি সাধুর ভেক ধরেছে।
ফার্মেসি দোকানটার সামনে দিনরাত ছোটখাটো ভিড় লেগেই থাকে। নিয়মিত ওষুধ কিনতে আসা এসব লোকের বাইরেও যারা আসে তারা আসলে ঠিক ওষুধ নয়, দোকানের মালিকের সাথেই রাজ্যের অপ্রয়োজনীয় কথায় ডুবে থাকে। ফার্মেসির মালিক রাজ্যের হিতোপদেশসহ নানা জ্ঞান বিতরণ করতে থাকে। এ ওষুধের দোকানের মালিকটা তার বেশ পরিচিত। সে যেখানে থাকে তার ৭০ থেকে ৮০ গজ দূরেই তার বাসা। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন ছাড়াও মাঝে মধ্যে অকারণ ঢুঁ মারে রোহিতও।
: ভাই আপনার এসব বকবকানি খুবই বিরক্তকর।
: মানুষকে অকারণে হিতোপদেশ দিই, এতে যদি কারো কোনো উপকার হয় তাহলে ভালো লাগে।
: এতে আপনার কী লাভ?
: লাভ-ক্ষতি বুঝি না, কারো যদি কোনো উপকারে লাগি তাহলে মনে শান্তি পাই।
লোকটার এসব অর্থহীন কথার কোনো মানে খুঁজে না পাওয়া রোহিত রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ফার্মেসির দোকান থেকে বেরিয়ে আসে।
সোফার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে রোহিত। মাথার ভেতর সব ফাঁপা। মোবাইল ফোন নিয়ে অহেতুক কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে ফের বাসা থেকে বেরুলো সে। নিরুদ্দিষ্ট হয়ে ফুটপাতে কিছুক্ষণ আপনমনে হাঁটাহাটির পর ভাবতে লাগলো পোড় খাওয়া অনুভূতির রঙ নিয়ে।
সুদৃশ্য টানেলের ভেতর ৭০ কিলোমিটার স্পিড নিয়ে ছুটছে রোহিতের মোটরকার। এসিটা অন করেই গাড়ি চালাচ্ছিল সে নিজেই। ক্রমে গাড়ির গতি কমে আসে।
: কি হলে গাড়ির গতি কমিয়ে আনলে কেন?
: কই না তো। এইতো অল্প একটু কমিয়ে দিলাম। তোমার সমস্যা হচ্ছে না তো?
: না।
: ও আচ্ছা।
এরপর কিছুক্ষণ মৌনতা। প্রায় ১০ মিনিট পর টানেল থেকে বেরিয়ে সোজা ইউটার্ন নিলো রোহিতের এলিয়ন মোটরকার। আচমকা হার্ড ব্রেক করায় কিছুটা ঝাঁকুনি খেয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ছিলো ওয়েলস। হঠাৎ মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে সিট বেল্ট খুলে দিলো সে।
: কী ব্যাপার তুমি হঠাৎ আমার সিটবেল্ট খুললে কেন?
: আমার মনে হলো এই সিটবেল্ট তোমার অস্বস্তির কারণ হচ্ছে। তাই খুলে দিলাম।
: মোটেই না।
এ কথা-ওকথার পর তাদের গাড়িটি থামলো বোট ক্লাবের সামনের উদ্যানে।
: আজ সন্ধ্যাটা একটু অন্যরকম।
: হুম। তোমার তো সবকিছুই অন্যরকম। কখন কী করে বসো তার কোন ঠিক আছে?
: যেমন
: তারপর কী খাবে বলো?
: কিছু না। ভালো লাগছে না।
: তোমাকে একটা কথা বলি। সবসময় একটা রূঢ় মনোভাব নিয়ে কথা বলার একটা বাতিক আছে তোমার।
: আমি এমনই।
ওয়েলসের কথাটা মনঃপুত হয়নি রোহিতের। বাসায় ফিরে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার কথাটি। কোনভাবেই তাকে রোমান্টিক ধাচে আনতে পারছে না রোহিত। এ কেমন বেরসিকতা। অস্থিরভাবে পায়চারি আর একটার পর একটা রথম্যান সিগারেট টেনেই চলেছে অনবরত। তার কোনো বিকার নেই। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে।
: তুমি কি ব্যস্ত?
আচমকা ওয়েলসের ফোন পেয়ে আপ্লুত রোহিত যেন নড়েচড়ে বসলো।
: বলো। ব্যস্ত না।
:একটু বের হতে পারবে ?
: হুম বলো কোথায় যাবে?
: নিউমার্কেট
: ওখানে কি শপিং করবে?
: বেশি বকবক না করে এক্ষণি চলে আসো।
ঘড়ির কাটায় ঠিক বেলা বারটায় নিউমার্কেটের নীচে দাঁড়িয়ে রোহিত। ওয়েলসের আসার নামগন্ধও নেই। অস্থির হয়ে আরেকটা সিগারেট বের করে মুখে গুঁজে দিতে যাবে অমনি সিগারেটটা এক ঝটকায় হাতে নিয়ে ফেলে দিলো ওয়েলস। মুহূর্তের আকস্মিকতায় কিছুটা অপ্রস্তুত রোহিতের মনটা অনাবিল পুলকের রোশনাইয়ে ভরে গেলো।
: অনেকক্ষণ ধরে তোমার জন্য বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে পড়ছিলাম। তাই সিগারেট ধরিয়ে সময় কাটাতে চেয়েছিলাম।
: ওসব কথা ছাড়ো। চলো আজ ফালুদা খাবো। অনেকদিন খাইনি
দুচোখ ছানাবড়া করে ওয়েলস এর দিকে তাকাতেই এক ঝটকায় তার চোখে হাতের আঙুল দিয়ে বোলাতে থাকলো সে।
: কী হলো চলো?
: হুম চলো।
এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে আগ্রাবাদের জাম্বুরি পার্কে কখন যে বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়েছিলো ঠিক ঠাহর করতে পারছে না রোহিত। মাথার ওপর রোদটা পড়ছিলো তীর্যক। তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন নিয়েই কাটিয়েছে সে! কোথায় সাতসমুদ্র তের নদীর পাড়ে ওয়েলস ; আর কোথায় রোহিত। হঠাৎ যেন রাজ্যের বিষাদ তাকে খুবলে ধরলো। কেনই বা বেঞ্চে শুয়ে পড়েছিলো সে তার কিছুই ঠাহর করতে পারছে না সে।
মাসখানেক খুব ব্যস্ত ছিলেন মোরশেদুল আলম চৌধুরী। প্রচুর কাজের চাপ ছিলো জাহাজে। পরিবারের কোনো খোঁজই নিতে পারেননি তিনি। কিন্তু মাসখানেক পর বাসায় ফিরে মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গিয়েছে তার। চারদিকে সব অগোছালো। বাসায় কেউ নেই। আসার বিষয়টা অবশ্য পরিবারের কাউকে জানাননি তিনি।
: কখন আসছো?
ঘাড় ফিরে পেছন ফিরতেই পরিবারের ৩ সদস্যকে একসাথে দেখে খুব ভালো লাগলো মোরশেদ সাহেবের।
: এবার এত দেরিতে ফিরলে?
: প্রচুর কাজ জমা হয়ে গিয়েছিলো। তোমাকেও বলা হয়নি।
: তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। কফি দিচ্ছি।
অনেকদিন কোন উপন্যাস পড়া হয় না। আজ কী মনে করে বুক সেলফ থেকে ম্যাক্সিম গোর্কি আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের দুটো বই নিয়ে পড়ায় ডুব দিলেন মোরশেদ সাহেব। এসব তার অভ্যাসে নেই।
: ওরে বাবা তোমার কি হলো?
: কই কিছু না তো।
: তুমি ম্যাক্সিম গোর্কি আর মাকোসের বই পড়ছো?
কিছুটা বিস্মিত মোরশেদ সাহেবের কথাটা ঠিক পছন্দ হয়নি।
: কেন? ওসব বই শুধু কি তুমি পড়ো? অন্যকেউ কি পড়তে পারবে না?
: না এমনি বললাম।
: না, তুমি এমনি বলোনি। তোমার এ কথাটা ঠিক ভালো লাগলো না।
: সব কিছুতে এমন রিয়েক্ট করো কেন?
: সবকিছুতে তর্ক করা তোমার এ অভ্যাসটা আমার পছন্দ না।
: তোমার পছন্দ না হলেও আমার কিছু যায় আসে না।
হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে এসে ওয়েলসকে একটা ধাক্কা দিলেন মোরশেদুল আলম সাহেব। আচমকা তার এমন উদ্ধত আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওয়েলস।
: তুমি আমার গায়ে ধাক্কা মারলে?
সজোরে হনহন করে বেডরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন মোরশেদ সাহেব। গত কিছুদিন ধরে তার মাথাটা ঠিক নেই। গালে হাত দিয়ে বারান্দার ব্যালকনিতে বসে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। হঠাৎ ভেতরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন ‘চলো খেতে যাই’। আজ আমার বাইরে ডিনার করব। ওয়েলসের ভাবান্তর নেই। স্বামী কী বললো না বললো তা না শুনেই একতলার সুনসান একটা রুমে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ চাপা দিয়ে অঝোরে কিছুক্ষণ কান্না করলো সে। মোরশেদ সাহেবের সাথে আগে থেকে বিভিন্ন বিষয় মতানৈক্য রয়েছে তার। কিন্তু কোনবার তো এমন রূঢ় আচরণ তার মধ্যে দেখা যায়নি। এর আগে মালয়েশিয়া থাকার সময় কোন একবার তুমুল ঝগড়া করে বাংলাদেশে চলে আসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেবার তার বাবা দেশ থেকে এসে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে বিরত রেখেছিলো। কিন্তু আজ বাবা নেই। মাও অনেকটা অসুস্থ দেশে। কতদিন দেশে যাওয়া হয় না। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সব স্বাদ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবনের এতটি সময় পার করে দিলো সে। স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে অনেকবার বললেও কোনো সাড়া মিলেনি। আজ প্রান্তিক সময়ে এসে সব কেমন এলোমেলো মনে হতে লাগলো।
: মা দরজাটা খোলো।
মেয়ের গলার স্বর শুনেও সাড়া দিলো না ওয়েলস। কিছু ভালো লাগছে না তার।
শোয়ার ঘরে উবু হয়ে কিছু একটা লিখার চেষ্টায় ছিলো রোহিত। হাতের বাম পাশে রাখা বালিশের ওপর সেলফোনটায় একনাগাড়ে ভাইব্রেশন হচ্ছে। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ওয়েলসের ফোন।
: কেমন আছো?
ওপার থেকে কোন শব্দ আসছে না।
: হ্যালো…..হ্যালো…….হ্যালো……
অনেকক্ষণ ধরে হ্যালো হ্যালো করার পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে ভীষণ এক উত্তেজনায় অস্থিরতা বেড়ে গেলো। কী করবে কিছু আঁচ করতে না পেরে ফোনটা কান থেকে না নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে।
: তোমার কী অবস্থা।
রোহিতের মনে হতে লাগলো অচেনা কেউ কথা বলছে। ওয়েলস এর গলার স্বর যেন মিলছে না। কী হলো তার।
:এইতো আছি, তোমার কী অবস্থা?
: ভালো। বাসার সবাই ভালো আছে?
: হুম। আচ্ছা তোমার গলার স্বরটা কেমন ভিজে মনে হচ্ছে।
: কই না তো। শোন এ বছরের শেষে বাংলাদেশে আসছি।
রোহিত কি ভুল কিছু শুনছে। গত চার বছরে দেশে আসা নিয়ে একটা টু শব্দও করেনি ওয়েলস। আজ হঠাৎ তার মধ্যে প্রত্যাবর্তনের সুর। রোহিতকে অবাক করে দিয়ে আরো যা জানালো ওয়েলস তাতে বিস্ময়ের কুহক ছিলো ঢের।
:তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে। আমি বিমানবন্দরে নেমেই তোমাকে ফোন করবো।
এও বুঝি সম্ভব। খুশিতে খেই হারিয়ে ফেরা রোহিতের আজ খুব গান করতে ইচ্ছে করছে। সেদিন বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়লো সে। নিজেকে নির্ভার মনে হতে লাগলো অনেকদিন পর।