সুপ্রভাত ডেস্ক »
একদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, তার মধ্যেই ক্রেমলিনের জন্য উটকো ঝামেলা হয়ে হাজির হয়েছেন ভাড়াটে গ্রুপ ওয়াগনারের প্রধান, গালিগালাজ আর ধমকানোর জন্য সুপরিচিত ইয়েভগেনি প্রিগোজিন।এই ঘটনা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে আনল বলে এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে।রুশ কমান্ডারদের ‘বেকুব’, ‘যুদ্ধাপরাধে’ দায়ী এসব বলার পাশাপাশি গত সপ্তাহে প্রিগোজিন সেনাবাহিনী রুশ ভূখ- রক্ষায় সক্ষম কিনা সে প্রশ্নও তুলেছিলেন। গোলাবারুদ সরবরাহে ধীরগতির অভিযোগ এনে তিনি ওয়াগনারের মৃত যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও তার চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভেলেরি গেরাসিমভকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছেন।‘শোইগু, গেরাসিমভ, গোলা কোথায়? এদের দিকে তাকাও, এদের দিকে তাকাও,”
মৃতদের ইঙ্গিত করে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াগনারপ্রধান বলেন, “তোমরা দামি ক্লাবে বসে আছো, তোমাদের ছেলেমেয়েরা ইউটিউবে ভিডিও বানাচ্ছে, আর এরা মরছে যেন তোমরা নিজেদের অফিসে বসে গোগ্রাসে গিলতে পারো!তার বাক্যবাণ থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও ছাড় পাননি। পুতিনকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘সুখী দাদা’, যিনি ভাবছেন ইউক্রেইনে যুদ্ধ খুব মসৃণভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।কিন্তু যদি দেখা যায় এই দাদা পুরোপুরি গাধা, তখন কী হবে?,” বলেছেন প্রিগোজিন।
সাদা চোখে- অন্তর্দ্বন্দ্ব
ওয়াগনার ও রুশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব বিশ্বের সবার সামনে সোপ অপেরা হয়ে হাজির হয়েছে। সর্বশেষ পর্বে চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে প্রিগোজিন বেশ কয়েকবার ইউক্রেইনের সামরিক গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। ডিসকর্ডে ফাঁস হওয়া তথ্যের বরাতে ওই নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, প্রিগোজিন বাখমুত থেকে ইউক্রেইনের সেনাদের সরে যাওয়ার বিনিময়ে কিইভকে রুশ সেনাদের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ক্রেমলিন যদি ওই নিবন্ধের কথা বিশ্বাস করে ফেলে, তাহলে প্রিগোজিন সত্যিই বিরাট বিপদে আছেন। কিন্তু তথ্য চেপে যাওয়া বা ইচ্ছা করে ভুল তথ্য দেওয়া ইউরেশিয়া অঞ্চলে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী অভিজাত বাহিনীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার ঘটনাও নতুন নয়, যদিও পুতিনকে এতদিন এসব সামলাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।কিন্তু প্রিগোজিনকে হয় এখন তিনি সামলাতে পারছেন না, বা তার ইচ্ছা নেই। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ক্রেমলিনের সর্বত্র তার নিয়ন্ত্রণ আর আগের মতো নেই।
তিনি রাশিয়ান রাষ্ট্রের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, এবং দৃশ্যত তার কোনো উত্তরসূরীও নেই। এখন পুতিন দুর্বল হয়ে পড়লে, তার শাসনামলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন আরও গুরুতরভাবে ওঠা শুরু করবে।
এনডিটিভিতে প্রকাশিত নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো সাধারণত নানান উপায়ে তাদের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। তার একটি হচ্ছে- রাষ্ট্র নিয়ে ভয় সৃষ্টি করা; বিদেশি শত্রু, দেশের ভেতরে থাকা শত্রুরা রাষ্ট্রের ক্ষতি করবে, শক্তিশালী নেতৃত্বই কেবল তা রুখতে পারে- এই থাকে তাদের ভাষ্য। এজন্য তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে শত্রুদের বিরুদ্ধে সফলতাও দেখাতে হয়।পুতিনের রাশিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়, তাকেও পশ্চিমা শত্রুদের বিরুদ্ধে সাফল্যের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা জারি রাখতে হয়। পরিস্থিতি যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন খুঁজতে হয় ‘বলির পাঁঠাকে’, যেন সব দায় মূল নেতার কাছ থেকে সরিয়ে অন্যদের ঘাড়ে দেওয়া যায়।
এমনটাই আমরা এখন দেখছি? রুশ সশস্ত্র বাহিনৗ ও ওয়াগনার পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে,” বলা হয়েছে ওই নিবন্ধে।
দোষারোপের খেলায় কে হারবে?
এটা রাশিয়ার জটিল নানামুখী ক্ষমতার কেন্দ্রে কার প্রভাব কত, কোন অংশের প্রধান পুতিনের কাছে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করবে। ক্রেমলিনে প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং তাদের নেতাদের কার কেমন দাপট তা খালি চোখে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু মনে করা হয়, প্রিগোজিন যেহেতু ক্রেমলিনে ‘আউটসাইডার’ তাই মস্কোতে তার তেমন ক্ষমতা নেই, নিরাপত্তা পরিষদের মন্ত্রণালয় বা সংস্থাগুলোর প্রধানদের মধ্যে তার বন্ধু সংখ্যাও নগণ্য। এখন তার হাতে থাকা সেনার সংখ্যাও আনুমানিক ৫০ হাজার, যার বেশিরভাগই হয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর। সে তুলনায় রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সেনার সংখ্যা দৈত্যাকার। এমনকি পুতিনের ব্যক্তিগত রক্ষীর সংখ্যাও ৩ লাখের বেশি।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে প্রিগোজিনের পক্ষে ক্রেমলিনকে বলির পাঁঠা বানানো প্রায় অসম্ভব, তার চেয়েও বেশি অসম্ভব পুতিনকে চ্যালেঞ্জ (যা ভেবে অনেকেই পুলকিত হচ্ছেন) জানানো। তবে ওয়াগনার ও প্রিগোজিন দুটোই পুতিনের কাছে এখনও গুরুত্বপূর্ণ। রুশ প্রেসিডেন্ট সাধারণত তার ঘনিষ্ঠদের সহজে ত্যাগ করতে চান না। পুতিন-প্রিগোজিন সম্পর্ক কয়েক দশক পুরনো। প্রিগোজিনের কোম্পানি একসময় ক্রেমলিনের আনুষ্ঠানিক সব ভোজে খাবার সরবরাহ করতো, এরপর তিনি ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি বানিয়েছেন, যে সংস্থাটি বিভিন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং রাশিয়ার হয়ে মিথ্য তথ্য ছড়াতো বলে কথিত আছে।
২০১৪ সালে প্রিগোজিন ভাড়াটে যোদ্ধাদের গ্রুপ ওয়াগনার প্রতিষ্ঠা করেন; এতে তার সঙ্গী ছিলেন রাশিয়ার বিশেষ সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক কমান্ডার দিমিত্রি উৎকিনও।
বাইরে থেকে দেখলে ওয়াগনারকে রাশিয়ার মূল সামরিক কাঠামো থেকে আলাদা মনে হবে না। এই বাহিনীর যোদ্ধারা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নেন, গ্রুপটির অনেক যোদ্ধাই একসময় রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে কাজও করেছেন। এছাড়াও এই বাহিনীর মূল কাজই থাকে সর্বত্র রাশিয়ার স্বার্থকে প্রসারিত করা। ২০২২ সালের মধ্যে ওয়াগনার বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় নিজের অবস্থান পোক্ত করে ফেলেছে। কেবল ইউক্রেইনই নয়, এটি এখন সিরিয়া, সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া, মোজাম্বিক, মালি, ক্যামেরুন ও মাদাগাস্কারসহ অন্যত্রও বেশ সক্রিয়। পুতিন যেখানে রাশিয়াজুড়ে পাষাণহৃদয় সামরিক সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে চান, প্রিগোজিন সেখানে নিজেকে সহিংসতা উদ্যাপনকারী হিসেবে প্রমাণে বেশি আগ্রহী। ইউক্রেইনে এক দলছুট সেনাকে হাতুড়িপেটায় হত্যায় তার অনুমোদনে তা বোঝাও গেছে। ইউরোপে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় ওয়াগনারকে যুক্ত করে নেওয়ার আহ্বানের প্রত্যুত্তরে তিনি ভুয়া রক্তমাখা একটি হাতুড়িও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে পাঠিয়েছিলেন।অবশ্য, এত কিছুর পরও, প্রিগোজিনকে মূলত রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ওপরই নির্ভর করে থাকতে হয়। রুশ সেনাবাহিনীই ইউক্রেইনে লড়াইয়ের সময় ওয়াগনারকে যাবতীয় গোলাবারুদ আর সরঞ্জাম সরবরাহ করতো।জেনারেল সের্গেই সুরোভকিনকে নিয়োগ করে পুতিন সেই বার্তা আরও জোরালভাবে দিতেও চেয়েছিলেন। সুরোভকিন ওয়াগনার ও রুশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে লিঁয়াজোর দায়িত্বে ছিলেন। সুরোভকিন চাইলেই প্রিগোজিনকে গোলাবারুদ পাঠানো পিছিয়ে দিতে বা বন্ধ রাখতে পারতেন।সামরিক বাহিনী এখন নতুন যোদ্ধা টানতে ওয়াগনারের আকর্ষণীয় চুক্তিতেও বাধ সেধেছে, যে কারণে প্রিগোজিন সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের প্রতি আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
পুতিনের ‘প্যারাডক্স’
সামরিক বাহিনীকে ঘিরে এই নাটক ক্রেমলিনের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সহজ কথায়, এটা পুতিনকে তার সিদ্ধান্তের ভুলত্রুটি থেকে নিজেকে আলাদা করা কঠিন করে তুলবে।ইউক্রেনে হামলার সিদ্ধান্ত পুতিন নিয়েছিলেন। পুতিনই ওয়াগনারকে বাখমুতে অভাবনীয় সাফল্য আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সবশেষে পুতিনই সমগ্র যুদ্ধ দেখভালের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর কোন কর্মকর্তা পালন করবেন, তা ঠিক করে দিয়েছেন। গেরাসিমভ এই দায়িত্ব সুরোভকিনের কাছ থেকে নিয়েছেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে। খবর বিডিনিউজ।
রাশিয়া অবশ্য ২০২২ সালে তাদের ‘সামরিক অভিযান’ শুরুর পর দায়িত্বে একের পর এক জেনারেল বদলেছে, অনেক জেনারেলকে যুদ্ধেও হারিয়েছে তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ব্যর্থতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো অবশ্য নানান সময়ে নানান জটিল ভাষ্য হাজির করেছে। অনেক সাংবাদিক ও সামরিক ব্লগাররা পুতিনকে দায়মুক্তিও দিচ্ছেন। তারা বলছেন, পুতিনের যে কৌশলগত লক্ষ্য, সামরিক বাহিনীর অদক্ষতায় তা অর্জন করা যাচ্ছে না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ভেতরে এই পচনের খবর পুতিন কি জানতেন না? আর যদি না-ই জানেন, তার নির্দেশ বাস্তবায়নকারীদের কাছ থেকে তিনি এতটা বিচ্ছিন্নই বা কেন? এটাই তৈরি করছে ‘প্যারাডক্স’। বোঝাচ্ছে- পুতিন হয় কিছুই জানেন না, নতুবা উদাসীন, অথবা দুটোই।
পুতিনের সুবিধা হচ্ছে, তিনি সাধারণ জনগণ ও অভিজাতদের ওপর নানামাত্রিক উপায়ে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে পারেন। কিন্তু বিজয়ের গল্প ফেরি করতে না পারলে, তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যদি অবাধ্য ব্যক্তিদের ঝেড়ে ফেলতে অস্বীকার করে, তাহলে তার বলির পাঁঠার সরবরাহও শেষ হয়ে আসবে। বাহিনীগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, এই সময়টা হয়তো দ্রুতই চলে আসবে, বলা হয়েছে এনডিটিভিতে প্রকাশিত নিবন্ধে।