যে পাঁচ কারণে জয়
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রভাত ডেস্ক :
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণে জো বাইডেন বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘আত্মা’কে ফিরিয়ে আনতে চান, দেশকে ‘বিভক্ত না করে ঐক্যবদ্ধ’ করতে চান।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার রাতে ডেলাওয়ার রাজ্যের উইলমিংটনে নিজের নির্বাচনী প্রচার সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ভাষণে বাইডেন বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সারিয়ে তোলার’ সময়।
ভোটের মাঠে তুমুল লড়াই আর অনেক তিক্ততার পর ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য পেনসিলভেইনিয়ায় জয়ের মধ্য দিয়ে গত শনিবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের ২৭৩টি ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত হয়। আর তাতেই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে বাইডেনের হোয়াইট হাউজে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়।
কয়েক ঘণ্টা পর উইলমিংটনে উৎসবমুখর সমর্থকদের সামনে ভাষণ দিতে এসে বাইডেন বলেন, ‘আমি এমন একজন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যিনি বিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন; যিনি লাল রাজ্য বা নীল রাজ্য দেখবেন না, শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে দেখবেন।
‘আমি চেয়েছিলাম আমেরিকার আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে, এই জাতির মেরুদ- মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুনর্গঠন করতে এবং আমেরিকার প্রতি ফের পুরো বিশ্বের শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে, এখানে বাড়িতে আমাদের মধ্যে একতা ফিরিয়ে আনতে।’
নির্বাচনে যারা তাকে ভোট দেননি তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এখন কর্কশ রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর দূরে ঠেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সময়, আবার একে অপরের দিকে তাকান, ফের একে অপরের কথা শোনেন আর এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা বন্ধ করুন।’
বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর এখন যা হবে
নানান নাটকীয়তা আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনই হোয়াইট হাউসের চাবি পেতে প্রয়োজনীয় ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ব্যাগে ভরতে পেরেছেন বলে সব রাজ্যের গণনাকৃত ভোটের ফলে স্পষ্ট হয়েছে।
তবে এর মানে এই নয় যে, এখনই তিনি তার যাবতীয় সব আসবাবপত্র নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির ১৬০০ পেনসিলভেইনিয়া অ্যাভেনিউর ঠিকানার হোয়াইট হাউসে উঠে যাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর হোয়াইট হাউসে আবাস গাড়ার আগ পর্যন্ত বেশ কিছু ধাপ ও আনুষ্ঠানিকতা পার হওয়া লাগে। সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের ঝঞ্জাট বাধে না। যদিও এবার ট্রাম্প ভোটের ফল নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দেওয়ায় খানিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব বিষয়ের উপরই কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।
জো বাইডেন কখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হবেন?
প্রথমে প্রত্যেক রাজ্যের ভোটের ফল প্রত্যয়িত হতে হবে। এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা, যা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় সময় ২০ জানুয়ারি দুপুরে নতুন প্রেসিডেন্টের চার বছরের মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের যাত্রা শুরু হয়; সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তাদের শপথ পড়ান। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী বছরের ২০ জানুয়ারিতে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের অভিষেক হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই সময়সূচির ব্যতিক্রমও হয়, যদি প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মারা যান কিংবা পদত্যাগ করেন তাহলে তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে যত দ্রুত সম্ভব শপথ নিতে হয়।
‘প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রানজিশন’ কী?
এটি হচ্ছে নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়কাল।
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট একদল লোককে একত্রিত করে তার ‘ট্রানজিশন টিম’ গঠন করবেন, যারা অভিষেকের পরপরই আগের প্রশাসনের যাবতীয় ক্ষমতা তাদের হাতে নিয়ে নেবে। বাইডেনের শিবির এরইমধ্যে একটি ‘ট্রাঞ্জিশন’ ওয়েবসাইট প্রস্তুত করে ফেলেছে।
এই ‘ট্রানজিশন টিম’ নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাই করবে, নতুন প্রশাসনে কোন কোন নীতি অগ্রাধিকার পাবে এবং দেশ পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করবে।
দলটির সদস্যরা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের সময়সীমা, বাজেট, কোন কোন আমলা কী করছেন সে বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করবেন।
বিভিন্ন কার্যালয়ে যারা নতুন প্রশাসনের হয়ে কাজ করতে আসবেন, তাদের সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং অভিষেকের পরও প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। দলটির কেউ কেউ ‘ট্রানজিশন পর্ব’ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নতুন প্রশাসনে থাকতে পারেন।
জো বাইডেন গত কয়েক মাস লাগিয়ে তার ‘ট্রানজিশন টিমটি’ গঠন করেছেন, তা পরিচালনা করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং গত সপ্তাহে তিনি এর ওয়েবসাইটও চালু করেছেন। খবর বিডিনিউজ ও বিবিসি বাংলা।
‘ট্রানজিশনের’সময় কমলা হ্যারিস কী করবেন?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম এ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট এই সময়ে তার দপ্তরে কর্মী নিয়োগ করবেন এবং আগের প্রশাসনের কাছ থেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানবেন।
হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট অফিস করলেও সেখানে তিনি থাকেন না।
ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যরা শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইউএস নেভাল অবজারভেটরি প্রাঙ্গণে থাকেন। হোয়াইট হাউস থেকে গাড়ি চালিয়ে সেখানে যেতে মিনিট দশেকের মতো সময় লাগে।
কমলার স্বামীর নাম ডাগ এমহফ। আইনজীবী এমহফের কর্মক্ষেত্র বিনোদন জগত। এমহফের প্রথম ঘরেও দুটি সন্তান আছে। তারা কমলাকে ‘মমলা’ বলে ডাকে বলে এর আগে জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত এ ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অতঃপর হোয়াইট হাউস…
এখন তো অনেকটাই ভালো। কিন্তু ১৮০০ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস ও তার স্ত্রী আবিগালি অ্যাডামস এ বাসভবনে উঠেছিলেন তখনও ভবনটি কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ধরে নেওয়া হয়, নতুন প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী সাদা বাড়িটির অঙ্গসজ্জা ও আসবাবপত্রে নানান পরিবর্তন আনবেন। এ জন্য কংগ্রেসের আলাদা বরাদ্দও থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবনটি এত বিশাল যে, সেখানে কক্ষই আছে ১৩২টি, বাথরুম ৩৫টি। নতুন বাসিন্দাদের এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
দেশটির এখনকার ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প ফ্যাশন জগতে ছিলেন; তিনি হোয়াইট হাউসের বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছেন। সাদা বাড়িতে বড়দিনের অনুষ্ঠানের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানেরও দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া
বৈশ্বিক নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন অথবা টুইট করেছেন; তাদের সেই প্রতিক্রিয়াগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অবলম্বনে তুলে ধরা হল।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো
‘যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে আমি জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক অসাধারণ- বিশ্ব মঞ্চে যা অনন্য।
‘যেভাবে আমরা একসঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জগুলো সামলিয়েছি তেমনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন, নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস, তাদের প্রশাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি আমি।’
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল
‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ভবিষ্যতে সহযোগিতার প্রত্যাশায় আছি। আমরা যদি আমাদের সময়ের বিশাল চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করতে চাই তাহলে আটলান্টিকের দুই পারের সম্পর্ক অটুট রাখার বিকল্প নেই।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন
‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় জো বাইডেনকে ও তার ঐতিহাসিক কৃতিত্বের জন্য কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন।
‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং আমি জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাণিজ্য ও নিরাপত্তার মতো আমাদের অংশীদারিত্ব মূলক অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে একসঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য সামনে তাকিয়ে আছি।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা
‘জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসকে উষ্ণ অভিনন্দন। জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী আরও শক্তিশালী করে তুলতে ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ও এর বাইরে শান্তি, স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আপনাদের সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ
‘আমেরিকানরা তাদের প্রেসিডেন্ট বেছে নিয়েছে। অভিনন্দন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস! আজকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অনেক কিছু করার আছে। একসঙ্গে কাজ করা যাক!’
ভারতের প্রধানমনন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
‘আপনার দর্শনীয় বিজয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জো বাইডেন! ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও অমূল্য ছিল। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ফের একসঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি আমি।’
কমলা হ্যারিসকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি
‘আন্তরিক অভিনন্দন কমলা হ্যারিস। আপনার সাফল্য অনন্য এবং বিপুল গর্বের বিষয়, যা শুধু আপনার মায়ের বোনদের জন্যই নয় বরং সব ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের জন্য। আমার বিশ্বাস আপনার সমর্থন ও নেতৃত্বে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণবন্ত মৈত্রী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
জো, আমাদের মধ্যে প্রায় ৪০ বছরের দীর্ঘ ও উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে আর আমি তোমাকে ইসরায়েলের একজন মহান বন্ধু বলেই জানি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে বিদ্যমান বিশেষ মৈত্রীকে আরও শক্তিশালী করার জন্য তোমাদের উভয়ের সঙ্গে কাজ করার জন্য অপেক্ষা করছি আমি।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
‘অভিনন্দন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস। গণতন্ত্র নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং অবৈধ কর স্বর্গ ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের জাতীয় সম্পদ চুরি বন্ধ করতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছি। পাশাপাশি আফগানিস্তান ও এই অঞ্চলের শান্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করে যাবো আমরা।’
যে পাঁচ কারণে জিতেছেন বাইডেন
যে ধরনের প্রচারণা ও নির্বাচন এবার যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে গেল সেটি ছিল নজিরবিহীন। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারি আর দেশজুড়ে দীর্ঘ সামাজিক সহিংসতার মতো অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই নির্বাচন। জো বাইডেন প্রায় ৫০ বছর ধরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা তার দীর্ঘদিনের। অবশেষে তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলেন তিনি। পাঁচটি কারণ জয়ে সাহায্য করেছে।
১. কোভিড, কোভিড, কোভিড
জো বাইডেনের জয়ের পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ যা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখ তিরিশ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
একইসাথে বদলে দিয়েছৈ মার্কিন মানুষের জীবন ও রাজনীতি। উইসকনসিনে নির্বাচনী র্যালিতে কোভিড-১৯ সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘ফেক নিউজে সবকিছুই কোভিড, কোভিড, কোভিড, কোভিড’।
মহামারি সম্পর্কে তার যে অবস্থান, যেভাবে তিনি বিষয়টি সামলেছেন সেটি শেষপর্যন্ত তার বিপক্ষেই গেছে।
অপরদিকে জো বাইডেন ক্যাম্প কোভিড ইস্যুতে যে অবস্থান নিয়েছিলেন সেটি তাকে এগিয়ে দিচ্ছে এমনটাই দেখা গিয়েছিল গত মাসে করা এক জনমত জরিপে।
করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখ তিরিশ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
যাতে জো বাইডেন ১৭ পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু বৈশ্বিক মহামারিতে যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
মহামারি ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়শই যেভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন, বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করেছেন, একদম হুট করে এলোমেলোভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এই বিষয়গুলো জো বাইডেন ক্যাম্প সফলভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজে লাগিয়েছে।
গ্রীষ্মকালে করা আর এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রেটিং ৩৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
২. হিসেব কষে ধীরগতির প্রচারণা
জো বাইডেন তার দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে ভুল বক্তব্য ও অসমীচীন কাজের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। যেসব ভুল তাকে প্রায়শই বিপদগ্রস্ত করেছে। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে এমন ভুল তার হারের কারণ ছিল। জো বাইডেন তার ভুল বক্তব্যের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন।
২০০৭ সালে আবার যখন তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবার তার তেমন একটা সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু তৃতীয়বার যখন ওভাল অফিসের জন্য লড়েছেন তখন তিনি বক্তব্য দেবার সময় যথেষ্ট কম হোঁচট খেয়েছেন। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে তার লাগামহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা বক্তব্যের কারণে নিয়মিত খবরের উৎস ছিলেন।
আর তাছাড়া বৈশ্বিক মহামারি, অর্থনৈতিক সংকট, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের সহিংস বিক্ষোভ এরকম জাতীয় পর্যায়ের বড় ঘটনার দিকে সমাজের মানুষের মনোযোগ বেশি ছিল। এর বাইরে এবার বাইডেন ক্যাম্প খুব হিসেব কষে এগিয়েছে। বাইডেনকে যতটা সম্ভব কম জনসম্মুখে আসতে দেখা গেছে।
প্রচারণার গতি এমন ছিল যাতে প্রার্থী ক্লান্তি থেকে অসাবধানতাবশত কিছু না করে বসেন। বাইডেন ক্যাম্প বরং ট্রাম্পকে তার মুখ খোলার সুযোগ দিয়েছে যা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে।
৩. আর যেই হোক ট্রাম্প নয়
নির্বাচনের দিনটির এক সপ্তাহ আগে জো বাইডেন ক্যাম্প তাদের সর্বশেষ টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রচার করে।
গত বছর জো বাইডেন প্রার্থী হিসেবে যখন মনোনীত হন এবং যেদিন তার প্রচারণা শুরু করেন সেসময়কার বক্তব্যের সাথে এই বিজ্ঞাপনের বক্তব্যে বেশ লক্ষণীয় সাদৃশ্য ছিল। লাগামহীন অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা বক্তব্যের কারণে নিয়মিত খবরের উৎস ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই নির্বাচনকে উল্লেখ করা হয় ‘যুক্তরাষ্ট্রের আত্মা রক্ষার যুদ্ধ।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরকে বিভক্তি ও বিশৃঙ্খলার সময়কাল বলে উল্লেখ করা হয়। ট্রাম্পের সময় যে মেরুকরণ হয়েছে, যে ধরনের বিতর্কের জন্ম তিনি দিয়েছেন মার্কিন জনগণ তা থেকে মুক্তি চেয়েছে। তারা শান্ত ও অবিচল একজন নেতা চেয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই বলেছেন তারা ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের আচরণে রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ।
বাইডেন ক্যাম্প ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে এই নির্বাচন যেন দুই প্রার্থীর মধ্যে যোগ্য একজনকে বেছে নেবার নির্বাচন নয়।
এটি যেন ট্রাম্প সম্পর্কে একটি গণভোটের মত বিষয়, এমন কৌশল ছিল বাইডেনের প্রচারণায়। জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নন, এমন বার্তা দেয়া হয়েছে ভোটারদের।
৪. মধ্যপন্থী অবস্থান
প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হবার লড়াইয়ে জো বাইডেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি বামপন্থী হিসেবে পরিচিত। আর একজন ছিলেন এলিজাবেথ ওয়ারেন। যার ক্যাম্পেইনে বেশ ভাল অর্থের যোগান ছিল।
এই দুজনের যেকোনো সভায় রক গানের কনসার্টের মতো মানুষ জড়ো হতো। কিন্তু জো বাইডেন উদারপন্থীদের চাপের মুখেও মধ্যপন্থী অবস্থান বজার রেখেছেন।
প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হবার লড়াইয়ে জো বাইডেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স ও এলিজাবেথ ওয়ারেন।
তিনি সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা, বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষা ও ধনীদের জন্য বেশি কর আরোপ করার নীতিগুলোতে সমর্থন দেননি। এর ফলে তিনি মধ্যপন্থী ও অসন্তুষ্ট রিপাবলিকানদের কাছে টানতে পেরেছেন। কমালা হ্যারিসকে রানিং মেট হিসেবে বেছে নেবার সিদ্ধান্তে এটি প্রকাশ পেয়েছে।
বার্নি স্যান্ডার্স ও এলিজাবেথ ওয়ারেনের সাথে শুধু একটি জায়গায় মতের মিল ছিল বাইডেনের। আর তা হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা। এই ইস্যু দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করেছেন তিনি যাদের কাছে জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৫. বেশি অর্থ, কম সমস্যা
এই বছরের শুরুতে জো বাইডেনের প্রচারণা তহবিল প্রায় শূন্য ছিল বলা যায়। ট্রাম্পের বিপক্ষে তার সীমাবদ্ধতা ছিল এটি। ট্রাম্পের প্রচারণা ছিল শত কোটি ডলারের বিষয়। কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে তহবিল গঠনে জোরালোভাবে লেগে পড়ে বাইডেন ক্যাম্প। অন্যদিকে ট্রাম্পের পদ্ধতি হচ্ছে বাড়াবাড়ি অপচয়। তহবিল গঠনে জোরালোভাবে করেছে বাইডেন ক্যাম্প।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে এসে ট্রাম্প ক্যাম্পের চেয়ে বড় তহবিল গড়েছিলেন বাইডেন।
অক্টোবর মাসে ট্রাম্পের চেয়ে ১৪৪ মিলিয়ন ডলার বেশি ছিল বাইডেনের তহবিলে। যা ব্যবহার করে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে রিপাবলিকানদের জর্জরিত করে ফেলা হয়।
কিন্তু শুধু অর্থ দিয়েই সব হয় না। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনও বড় তহবিল গড়েছিলেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস মহামারির কারণে একদম মানুষের কাছে গিয়ে প্রচারণা অনেক কমিয়ে দিতে হয়েছে। মানুষজন অনেক বেশি সময় ঘরে কাটিয়েছে তাই গণমাধ্যমের প্রতি তাদের মনোযোগ অনেক বেশি ছিল। ভোটার আকর্ষণ করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গণমাধ্যমে বার্তা দিয়ে গেছেন জো বাইডেন।