হুমাইরা তাজরিন »
সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখার স্বপ্ন কম বেশি সকলেরই থাকে। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কণ্টকময় পথ অতিক্রম করেন একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন। এবার সে ধরনের দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিচ্ছেন চট্টগ্রামের সন্তান ডাক্তার বাবর আলী। তিনি পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট ( ২৯,০২৮ ফুট) ও চতুর্থ উচ্চতম পর্বত মাউন্ট লোৎসে ২৭,৯৪০ ফুট) অভিযানে যাচ্ছেন। একই সাথে দুটো সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে অভিযান বাংলাদেশে এর আগে কেউ করেনি।
বাবর আলী চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার নজুমিয়াহাট এলাকার প্রবাসী লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের সন্তান। চার ভাই বোনের মধ্যে বাবর আলী মেজ।
সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে পড়াকালীন বাবর আলীর পর্বতারোহণের প্রতি কৌতূহল জন্মে। তবে বয়স কম হওয়ায় সুযোগ হয়ে উঠেনি। স্কুল পেরিয়ে ভর্তি হন ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তারপর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ে তিনি আরোহন করেন। ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়তে থাকে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নিলেও বাবরের অন্যতম নেশা পর্বতারোহণ।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ২০১০ সালে তিনি ট্রেকিংয়ের হাতেখড়ি নেন। পরবর্তী যা পৌঁছেছে ভারত-নেপালের হিমালয়ের বিভিন্ন উচ্চতা অব্দি। মূলত ২০১৪ সাল থেকেই পর্বতারোহণ শুরু করেন তিনি। ইতোমধ্যে হিমালয়ের চার থেকে ছয় হাজার মিটারের বেশ কয়েকটি উচ্চতা তিনি ছুঁয়েছেন। ২০১৭ সালে ভারতের উত্তরকাশীর নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে তিনি বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করেন। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম ( ২২,৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন।
সুপ্রভাতের সাথে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা হয় পর্বতারোহী বাবর আলীর।
সুপ্রভাত : পর্বতারোহণের প্রতি কীভাবে আগ্রহী হলেন?
বাবর আলী : আমি স্কুলে পড়াকালীন কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের একটি বই পড়ি। বইটির নাম ছিলো ‘গর্ভধারিনী’। যেখানে পর্বতারোহণের কথা ছিলো। পর্বতারোহণের বিষয়টি আমাকে বেশ আন্দোলিত করে। আমার ইচ্ছে জন্মায় পর্বতারোহণের। তবে সেসময় বয়স কম থাকায় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। পরে স্কুল পেরিয়ে কলেজ ভর্তি হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে আশপাশের পাহাড়গুলো, তারপর বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে আমি আরোহণ করি এবং আমার স্বপ্ন বড় হতে থাকে।
সুপ্রভাত : পৃথিবী সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ আরোহণের প্রস্তুতি কেমন?
বাবর আলী : আমি প্রায় ১০ বছর যাবত পর্বত আরোহণ করছি। ইতোমধ্যে হিমালয়ের বেশকিছু উঁচু পর্বত আরোহণ সম্পন্ন করেছি। বেশ কিছু মাস যাবত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণগুলো নিচ্ছি। উচ্চতা এবং তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল রপ্ত করছি। নিয়ম মাফিক হাঁটা, প্রাণায়াম করা, ভারী বস্তু কোমর বেঁধে চলা ইত্যাদি অনুশীলন করেছি।
সুপ্রভাত : এভারেস্ট ও লোৎসে আরোহণের সফর কেমন হবে?
বাবর আলী : আগামী ১ এপ্রিল কাঠমা-ুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে রওনা হবো। কাঠমা-ু থেকে পর্বতারোহণের সরঞ্জামসমূহ কেনাকাটা করে লুকলার উদ্দেশে রওনা হবো। সেখানে সপ্তাহখানেক ট্রেকিং চলবে। সেখান থেকে এপ্রিলের ১৪ তারিখ নাগাদ পৌঁছাবো বেস ক্যাম্পে। সেখানে থেকেই উঁচু ক্যাম্পগুলোতে ওঠানামা করে উচ্চতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। পুরো অভিযানটিতে সময় লাগবে প্রায় ২ মাস। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী মে মাসের তৃতীয় বা শেষ সপ্তাহে অভিযান শেষ হবে। এই অভিযানে পৃষ্ঠাপোষক এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও কয়েকজন ব্যক্তি। অভিযানটিতে প্রায় ৪৫ লাখ খরচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার সাথে বিভিন্ন দেশের কয়েকজন আরোহীও অভিযানে যুক্ত হবেন।
বাবর আলীর উল্লেখযোগ্য পর্বত অভিযানগুলো হলো- সারগো রি (৪,৯৮৪ মিটার), সুরিয়া পিক (৫,১৪৫ মি.), মাউন্ট ইয়ানাম (৬,১১৬ মি.), মাউন্ট ফাবরাং (৬,১৭২ মি.), মাউন্ট চাউ চাউ কাং নিলডা (৬,৩০৩ মি.), মাউন্ট শিবা (৬,১৪২ মি.), মাউন্ট রামজাক (৬,৩১৮ মি.) ইত্যাদি। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন মাউন্ট আমা দাবলাম (৬,৮১২ মি.) ও চুলু ইস্ট (৬,০৫৯ মি.)। পর্বতারোহণ ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি।
পাহাড়ের সাথে সাথে ক্লাইম্বিং, সাইকেল চালানো, কায়াকিং, হাফ ম্যারাথন, ফটোগ্রাফি, স্কুবা ডাইভিং ইত্যাদিও চলছে সমানতালে। ২০১৯ সালে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন দেশের ৬৪ জেলা। দেশ দেখা আর মানুষের সাথে ভাব বিনিময় ছাড়াও পদযাত্রাকালীন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য গণসচেতনতা তৈরি করে গেছেন দেশের পথে-প্রান্তরে। ২০২৩ সালে ভারতের সর্ব উত্তরের বিন্দু কাশ্মীর থেকে সর্ব দক্ষিণের বিন্দু কন্যাকুমারী অবধি প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছেন।