সুপ্রভাত ডেস্ক »
কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এভাবে মায়ের কোল খালি হোক আমি চাই না। কারণ আমি তো বাবা-মা সব হারিয়েছি, আমি তো জানি হারানোর ব্যথা কত কষ্টের। আর সেই ব্যথা বুকে নিয়েই ফিরে এসেছি এই দেশের মানুষের জন্য।’
শনিবার (২৭ জুলাই) সকালে আন্দোলনে আহতদের দেখতে শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন-নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল) যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। খবর বাসস।
দেশের উন্নয়নের নিজের ব্যক্তিগত কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আমার তো কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি তো ছেলে-মেয়েদের জন্যও কিছু করিনি। শুধু তাদের লেখাপড়া… নিজেরাই চাকরি করে লেখাপড়া করেছে। আমি কতটুকুইবা তাদের জন্য করতে পেরেছি। কিন্তু আমি দেশের মানুষের জন্য করেছি। আজ অন্তত মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, তাদের কাজের সংস্থান; সবই তো করে দিচ্ছিলাম। যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলাম, তখনই তাণ্ডব করে ঠিক যে জায়গাগুলো (প্রতিষ্ঠান) মানুষের সেবা করবে, সে জায়গাগুলোতে আঘাত করা হলো।
শিক্ষার্থীরা এখনও আন্দোলন না থামানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্ত দাবি মেনে নেওয়ার পরেও তাদের আর সেই শাটডাউন শেষ হয় না, কী কারণে আমি বুঝি না। আমরা তো সবগুলো দাবিই মেনে নিয়েছি। একটা মানলে আরেকটা, আরেকটা মানলে আরও একটা! আর এর ফল আজকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব একদিকে ছারখার, আর আজকে কত মানুষ জীবন হারালো! কতগুলো মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে! কতগুলো মানুষ…।’
২০০১ সালেও এ রকম তাণ্ডব বিএনপি-জামায়াত জোট চালিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রায় ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করে। কত মানুষ গুলি খেয়ে…তাদের ঘর-বাড়ি…হাত-পা কেটে দেওয়া, চোখ তুলে নেওয়া, মেয়েদের রেপ করা— এই তাণ্ডব ছিল। আবার ২০১৩ সালে অগ্নিসন্ত্রাস। ১৩, ১৪, ১৫ (সালে) আগুন জ্বালানো। বাসের ভেতরে মানুষ, সেখানেও আগুন জ্বালানো। ২০২৩ সালে সেই তাণ্ডব আর প্রতিবারই পুলিশের ওপরে আঘাত। পুলিশকে হত্যা, মানুষ মেরে ঝুলিয়ে রাখা—পুলিশ মেরে ঝুলিয়ে রাখা। গাজীপুরে আমাদের কর্মী মেরে ঝুলিয়ে রাখা। এটা কী ধরনের রাজনীতি আমরা জানি না।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে দাবি করেছে, প্রত্যেকটা দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। মামলা তো তাদের না! আমার করা প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়, সরকারের পক্ষ থেকেই তো আমরা আপিল করি। হাইকোর্টের সেই রায় স্থগিত করে দেওয়া হয়। তাহলে আন্দোলনটা কীসের জন্য ছিল! একেবারে শাটডাউন করে সবাইকে, তারপর মারা। যেসব ঘটনা ঘটেছে, যেভাবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যারা মারা গেছে আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর যারা এখন আহত, তাদের সকলের চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে।’ এসময় চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে আমরা করে দেবো, করে দিচ্ছি। আর যারা পা হারিয়েছে বা হাত হারিয়েছে, আমরা কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দেবো যাতে তারা আবার সুস্থ মানুষের মতো চলতে পারে, নিজের কাজ করতে পারে। এর মধ্যে একজন আবার প্রতিবন্ধীও, কাজেই তার মা যাতে ভালোভাবে চলতে পারে; প্রতিবন্ধীদের অবশ্য আমরা ভাতাও দিচ্ছি কিন্তু তাকে আরও ব্যবস্থা করে দেবো। আমাদের যতটুকু সাধ্য করে দেবো। কিন্তু আমার দেশবাসীর কাছে আমি বিচার চাই। অপরাধটা কী করেছি যে এইভাবে… যেখানে আমি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সেই ২০০৮ এর বাংলাদেশ আর ২০২৪-এর বাংলাদেশ তো এক না! বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান তো উন্নত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি কত উপরে উঠে গিয়েছিল। এটা মনে হলো আর কিছুই না, আমাদের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ভিক্ষুকের জাতি করে দেওয়া। এটাই বোধ হয় এদের পেছনে ষড়যন্ত্র। সেটাই হচ্ছে সব থেকে দুঃখজনক। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে যখন একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম, আজকে সেখানে দেখি একদিকে জ্বালাও-পোড়াও সব কিছু। ঠিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সেবা দেয়, আজকে মেট্রোরেলে চড়ে মানুষ কত অল্প সময়ের মধ্যে সময় বাঁচিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারতো, আবার ফিরতে পারতো, সেখানে ছাত্ররা-চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষ সবাই তো যেতে পারতো। সেই স্টেশনগুলো পুড়িয়ে এখন ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের কষ্ট।’
সাধারণ মানুষের কাছে নাশকতাকারীদের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো কষ্ট লাঘব করেছি কিন্তু যারা এভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষকে সেই কষ্টে আবার ফেলে দিলো, তাদের বিচার এ দেশের মানুষকেই করতে হবে। আমি সবার সহযোগিতা চাই।’
শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। আহতদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন।
নিটোর পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী শামীম উজ্জামান আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রী আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন।
সরকার প্রধানের সঙ্গে এই সময় অন্যান্যের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মহাখালীতে অবস্থিত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সংশ্লিষ্টরা এই সময় উপস্থিত ছিলেন। সরকার প্রধান একইসঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞও পরিদর্শন করেন।