ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি »
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এ মহামানবের জন্ম যদি না হতো, বাংলাদেশ কখনও স্বাধীন হতো না। তাঁর শততম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬-দফার ঘোষণা দেন। আমি তখন লাহোর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম। তখন লাহোরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন ছিল। যার নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র পরিষদ। আমি ছিলাম এই ছাত্র পরিষদের নির্বাচিত সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ঘোষণার পর আমরা ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ এটি পড়ে দেখলাম এবং বুঝলাম যে,এটিই পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের যথাযথ মুক্তির সনদ।আমরা সভা ডেকে একে সাদরে গ্রহণ করলাম এবং এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানালাম। ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আমি স্বধামে ফিরে এলাম। তখন আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন।তিনি কথা বলতে পারতেন না। আমার পাসের খবর শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। ইশারায় তিনি আমাকে দোয়া করলেন।
১৯৬৪ সালে আমার আব্বা কক্সবাজারে বেসরকারিভাবে প্রথম আবাসিক হোটেল সায়মন প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশে ফেরার পর ১৯৬৭ থেকে আমি এ হোটেল দেখাশোনার, পরিচালনার দায়িত্ব নিই। শুরুতেই এটি ছিল একটি ১২ কক্ষের হোটেল। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এটিকে আরও সম্প্রসারণ করি এবং হোটেলের মাঝখানে একটি লন নির্মাণ করি। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে কক্সবাজারে আমার হোটেলের অফিসে আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আসেন। তাঁরা বললেন বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিক সফরে কক্সবাজার আসবেন। আমার কাছে তাঁরা কিছু চাঁদা চাইলেন, আমি দিলাম। আমার হোটেলের লনে বঙ্গবন্ধুকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেয়ার জন্য আমি নেতৃবৃন্দকে প্রস্তাব দিলাম। তাঁরা রাজি হলেন। সকল শ্রেণি পেশার লোকদের দাওয়াত দিতে বললাম। বঙ্গবন্ধুও এ নাগরিক সংবর্ধনায় আসতে সম্মতি জানালেন। আমি নাগরিক সম্বর্ধনা উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জন্য বিশেষ একটি ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করি।
এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সাথে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এমএ মান্নান, মির্জা আবু মনসুরসহ কক্সবাজারের অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর পাশে বসার।আমি বঙ্গবন্ধুর পাশে বসেই ডিনারসহ যাবতীয় অনুষ্ঠান উপভোগ করি। আলাপচারিতার এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধু আমাকে বিশেষভাবে তৈরি ক্যান্ডেল লাইট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কি বাজারে পাওয়া যায়? আমি বললাম, না। এটি আমি আপনার জন্য বিশেষ উপায়ে তৈরি করেছি। উনি খুব খুশি হলেন। নৈশভোজ শেষে তিনি আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলেন এবং এ আয়োজনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে আমার হোটেলের সম্প্রসারিত কক্ষগুলো ঘুরে দেখালাম।তিনি খুশি হয়ে বললেন,“তোর এখানে রুম আছে, আমি কেন উপলে উঠলাম।” আমি বললাম আপনি যখন পরবর্তীতে কক্সবাজার আসবেন আশা করি আপনি তখন আমার এখানেই থাকবেন।
এরপর আমরা সকলেই উনার সাথে উপলে যাই। তিনি খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। খাটের চতুর্পাশে আমরা সবাই দাঁড়িয়েছিলাম।তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন। আলাপের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাডভোকেট নূর আহমদকে লক্ষ্য করে বললেন, “এই নূর আহমদ তুইমাওলানা ফরিদকে পরাজিত করতে পারবি?” নূর আহমদ তখন বললেন, মাননীয় বঙ্গবন্ধু আপনি দোয়া করলে নিশ্চয়ই আমি তাকে পরাজিত করতে পারবো। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথেই বলে উঠলেন, “তোরা আমাকে ১৫১টি আসন আইন্যা দে, আমি দেখাইয়া দিমু।” বঙ্গবন্ধুর এ কথাতে কি নিহিত ছিল কারও আর বোঝার বাকি রইলো না। স্বাধিকার আর স্বাধীনতা তাঁর মনে যে প্রোথিত ছিল তা এ কথাতেই বুঝতে পারলাম। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে আমি বুঝলাম একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধ ছাড়া এ দেশ কখনও স্বাধীন হবে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সেটিই বুঝিয়ে দিলেন। এ ভাষণের প্রতিটি কথায় দেশের মানুষ স্বাধীনতার নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। মীরসরাই’র শুভপুর ব্রিজটি ছিল তৎকালীন ঢাকা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সে সময় চট্টগ্রামে প্রবেশের জন্য এটি ছাড়া বিকল্প আর কোনো ব্রিজ ছিল না । আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম শুভপুর ব্রিজটি যদি কোন উপায়ে ধ্বংস করা যায় তাহলে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারবে না। আমরা চট্টগ্রামকে স্বাধীন রেখেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবো। এ জন্য বিস্ফোরক জোগাড় করতে হবে । আমার কিছু বন্ধু আছে তাদের কাছ থেকে এ বিষ্ফোরক সংগ্রহ করা যাবে। আমার পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুকে জানানো দরকার। আমি জানে আলম দোভাষকে সঙ্গে নিয়ে ১৭ মার্চ সকালে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি । এদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। আমার পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানাতেই তিনি আমার বুকে হাত রেখে বললেন, “সাবাস, তুই বিস্ফোরক জোগাড় করে অর্ধেক দিয়ে শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিবি। আর বাকি অর্ধেক ঢাকায় রেখে যাবি ।” ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে সিলেটে আমার বন্ধুদের কাছে চলে গেলাম । বন্ধুদের কাছ থেকে বিষ্ফোরক জোগাড় করতে পারলেও ডেটোনেটর যোগাড় করতে পারলাম না। ফলে বিফল মনে চট্টগ্রাম ফিরে আসলাম। আমার সাথীদের নিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শুভপুর ব্রিজে পৌঁছি। ব্রিজের দু’পাশে দু’জন পহারাদার ছিল, আমি তাদের চলে যেতে বললে তারা চলে যান। ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য কোনো বিষ্ফোরক না পেয়ে আমি প্রচুর পরিমাণে বিটুমিন ও কেরোসিন জোগাড় করি। সাথীদের নিয়ে ব্রিজের কাঠের অংশে সংগৃহীত বিটুমিন ও কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করি। প্রচ- আগুনে ব্রিজের কাঠের অংশ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। যার ফলে ব্রিজটি এক প্রকার ধ্বংস হয়ে সম্পূর্ণরূপে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়েপড়ে। ফলশ্রুতিতে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে রওয়ানা হওয়া ২৬টি সাঁজোয়া যান শুভপুর ব্রিজে এসে বাধাগ্রস্ত হয়।
১৯৭৪ সালে জহুর আহমেদ চৌধুরী মারা যাবার পর এ আসনে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে উপ-নির্বাচন করানোর জন্য বঙ্গবন্ধু চিন্তা করেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধু খোঁজখবর- নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন জানে আলম দোভাষকে দিলে ভাল হবে। কারণ এ নির্বাচনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘ সফরের কথা রয়েছে। একদিন তোফায়েল ভাই নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে আমার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে আর মান্নান ভাইকে নিয়ে যাবার জন্য। মান্নান ভাইকে না পেয়ে তোফায়েল ভাই আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, “চট্টগ্রামের লোক ধারে কাটে, ভারেও কাটে।” আমি জানে আলম দোভাষকে মনোনয়ন দিব। আমি বললাম আপনি সিরাজ মিয়া , ইদ্রিস আলম ও মান্নান ভাইকে টেলিফোনে একটু বলে দেন। তিনি তখনই মান্নান ভাইকে টেলিফোন করলেন এবং বললেন, “আজ ৫টার ফ্লাইটে তুই আর মোশাররফ চট্টগ্রাম যাচ্ছিস । আমি সিদ্ধান্ত নিলাম জানে আলম দোভাষকে মনোনয়ন দিব। তোরা চট্টগ্রাম গিয়ে জানে আলম দোভাষের সাথে দেখা করবি এবং আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবি।” আমরা চট্টগ্রাম এসে সার্কিট হাউজে জানে আলম দোভাষকে ডাকলাম এবং বললাম জহুর আহমেদ চৌধুরীর শুন্য আসনে আপনাকে নির্বাচন করতে হবে । এ কথা শুনে তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নাই । মিউনিসিপ্যালটি নির্বাচনে আমার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে । আমি নির্বাচন করতে পারব না। দু’দিন পর চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ বি চৌধুরী আমাদের টেলিফোন করে জানালেন, আপনাদের (আমি, মান্নান ভাই এবং জানে আলম দোভাষ) টিকেট কাটা হয়েছে ; বঙ্গবন্ধু আপনাদের ঢাকা যেতে বলেছেন। বিকেলে গণভবনে গেলাম । বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাশে বসালেন। এ সুবাদে কেউ না শোনার মত আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচন করে জানে আলম দোভাষের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এখন তার কোন টাকা নেই। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ওর কোন টাকা খরচ করা লাগবে না । নির্বাচনের সব টাকা আওয়ামী লীগ দিবে। আওয়ামী লীগের জন্য এ পরিবারের অনেক অবদান আছে। আমি তখন বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিলাম, আপনি আলাদা করে তার সাথে একটু কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আলাদা একটি কক্ষে গিয়ে ১৫/২০ মিনিট তার সাথে কথা বললেন। পরে জানে আলম দোভাষকে দেখলাম উৎফুল্ল মনে বেরিয়ে আসতে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি আলাপ হলো, আর কোন অসুবিধা আছে? তখন তিনি বললেন , না। এই নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আজিজ ভাইয়ের বড় ছেলে নুরউদ্দিন জাহেদ মঞ্জু। তার পক্ষে মুসলিম লীগ ও জামায়াতসহ স্বাধীনতা বিরোধী সকল শক্তি একযোগে কাজ করেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই নির্বাচনে আমরা কঠোর পরিশ্রম করে জয়লাভ করি। এ নির্বাচনের পরই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করেন এবং প্রথমবারের মত বাংলায় তাঁর বক্তব্য সেখানে উপস্থাপন করেন।
এখানে উল্লেখ্য, এমএ হান্নান আর জহুর আহমেদ চৌধুরী মারা যাবার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে অত্যন্ত ¯েœহের চোখে দেখতেন। যখনই উনার সাথে দেখা হতো তখনই তিনি কুশল বিনিময় করতেন, ডেকে পাশে বসাতেন । জহুর আহমেদ চৌধুরী মারা যাবার পূর্বে একদিন সংসদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘মোশাররফ’ জহুরকে দেখতে গিয়েছিস? সে বোধ হয় আর বাঁচবে না। পিজি হাসপাতালে গিয়ে তাঁকে দেখে আসিস।” আমি পিজিতে জহুর আহমদ চৌধুরীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। এ সময় জহুর আহমদ চৌধুরী আমার বাবাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান।
১৯৭৪ সালে বাকশাল গঠনের জন্য জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করা হয়। তিন দিন বিরতির পর বিল পাস হওয়ার কথা। বিল পাসের নির্ধারিত দিনে ঢাকায় আসার জন্য আমি আর জানে আলম দোভাষ সকালে বিমান বন্দরে যাই । কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইট ছাড়েনি। এ সময় বিমান বন্দরে রাশিয়ার একটি হেলিকপ্টার ত্রাণ কাজের জন্য অবস্থান করছিল। এটি ঢাকা আসার কথা জেনে আমরা বুঝিয়ে এ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসি। কিন্তু সংসদে যখন আসলাম তখন অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে। কঠোর নিরাপত্তার কারণে আমরা ভিতরে প্রবেশ করতে পারলাম না । বিলটি সংসদে উপস্থাপনের সময় যত ভোটে গৃহীত হয়েছিল, দেখা গেল এটি পাস হয়েছে দুই ভোট কমে। তখন বঙ্গবন্ধু এ দুই ভোট সম্পর্কে জানতে চাইলে হুইপ বললেন, চট্টগ্রামের মোশাররফ ও জানে আলম দোভাষ অনুপস্থিত ছিলেন। বিল পাসের পর আমরা ভিতরে ঢুকলাম । ইতোমধ্যেই সংসদে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। আমরা লবিতে দাঁড়িয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শপথ নিয়ে হেঁটে তাঁর কক্ষে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “কিরে মোশাররফ তুই আসতে দেরি করলি ক্যান ?” তখন তিনি আমার মুখে তার ডান হাত দিয়ে আলতোভাবে চড় দিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাত ভারি হওয়ায় আমার সামান্য লাগে। তিনি সেটি বুঝতে পেরে আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রথম তোকেই আঘাত করলাম। বঙ্গবন্ধুর এই আলতো আঘাত আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে রইলো । আমি এখনো তা মাঝে মাঝে অনুভব করি। তিনি আমার এলাকার খোঁজ-খবরও রাখতেন । একবার মহামায়া লেকের বিষয়ে আলাপ করতে গেলে তিনি এটিকে রাষ্ট্রপতির পাইলট প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে তিনি সপরিবারে নিহত হওয়ায় এটি তখন আর বাস্তবায়ন হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আমি মন্ত্রী হবার পূর্বে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। জাতীয় পানি সম্পদ কমিটিও ছিল এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কমিটির একটি সভায় মহামায়া প্রকল্পের বিষয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেতিনি তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাককে এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন এবং যথাসময়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় । এ সময় প্রকল্পের শতকরা ৮০% কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে এ কাজের গতি মন্থর হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার এটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করে। যেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উদ্বোধন করেন।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে এবং নওগাঁর আব্দুল জলিলকে জাপানে অনুষ্ঠিত ৬৪তম আইপিইউ সম্মেলনে আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে যোগদানের জন্য মনোনীত করেন। এ সফরের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে তৎকালীন চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেমসহ ৮ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তিনি তাদের কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে আমাদের দু’জনকে মনোনীত করেন। বঙ্গবন্ধুর এ অপার ¯েœহে আমরা দু’জনেই অভিভূত হয়ে যাই। এ বছর মা’ এর সাথে হজে যাবার জন্য লটারিতে আমাদের নাম ওঠে। হজের বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করার জন্য আমি একদিন ৩২ নম্বরে যাই। সে সময় তিনি গণভবন ছেড়ে ৩২ নম্বরে থাকতেন। আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে। এ সময় কোনো আর্মি বা পুলিশ আমার নজরে পড়েনি। আমি সোজা অভ্যর্থনা কক্ষে গেলাম । বললাম আমি চট্টগ্রামের মোশাররফ ; বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে খবর দিলে বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে আমাকে ওপরে যেতে বলেন । আমি ওপরে ওঠে দেখলাম তিনি লুঙ্গি পরে আছেন । আমাকে দেখেই স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে পাশে বসতে বললেন । আমি হজের বিষয়টি উনাকে জানালাম। তিনি বললেন , কই তোর নামতো দেখিনি। আমি বললাম আমাদের নাম লটারীতে উঠেছে । তখন তিনি বললেন, “তুই খুবই ভাগ্যবান। মাকে নিয়ে হজে যাচ্ছিস ।” এরপর বললেন, “যা ঘুরে আস।্ দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন কর্মসূচি দেব।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এরূপ শত শত স্মৃতি আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ ¯েœহ ও ভালবাসা কখনও ভোলার নয় । তিনি তাঁর জীবনের মূল্যবান সময়টুকু অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। প্রায়শ বঞ্চিত হয়েছেন পারিবারিক সদস্যদের ভালবাসা থেকে। কিন্তু তাঁর সম্বল ছিল এে দশের মানুষের ভালবাসা। দেশের জন্য সপরিবারে নিজের জীবনও তাঁকে উৎসর্গ করতে হয়েছে। শততম জন্ম বার্ষিকীতে এ মহামানবের প্রতি আবারও গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি । ’৭৫ এর ১৫ আগস্টে নিহত বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।