শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
কালের আবর্তে ঢাকা পড়ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস। নবীনদের অনেকেই জানেন না- চট্টগ্রামের প্রায় ১১৬টি স্থানে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় বধ্যভূমির স্বীকৃতি পেয়েছে কেবল দুটি স্থান।
জানা যায়, ১১৬টি বধ্যভূমির মধ্যে নগরে রয়েছে ৬১টি। এরমধ্যে পাহাড়তলীতে আছে ১৫টি, লালখান বাজারে ৬টি, হালিশহরে ৫টি, গোসাইলডাঙ্গায় ৫টি, আন্দরকিল্লায় ৪টি, বাকলিয়ায় ৩টি, রহমতগঞ্জে ২টি, কাট্টলীতে ২টি, পতেঙ্গায় ২টি, বন্দর এলাকায় ২টি, কাটগড়ে ২টি, মুরাদপুরে ২টি, নাসিরাবাদে ২টি, মাদারবাড়িতে ২টি, পাঁচলাইশে ২টি এবং চন্দনপুরা, জয়পাহাড়, চান্দগাঁও, ষোলশহর ও রামপুরায় একটি করে বধ্যভূমি রয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মহামায়া ডালিম হোটেল বধ্যভূমি, গুডসহিল বধ্যভূমি, পশ্চিম পাহাড়তলী বধ্যভূমি, দক্ষিণ বাকলিয়া মোজাহের উলুম মাদরাসা বধ্যভূমি, চাক্তাই খালপাড় বধ্যভূমি, চামড়ার গুদাম চাক্তাই খাল পাড় বধ্যভূমি, তুলসী ধাম সেবায়েত মন্দির বধ্যভূমি, হাইওয়ে প্লাজা ভবন বধ্যভূমি, বাটালী পাহাড়ের রেলওয়ে বাংলো বধ্যভূমি, পাঁচলাইশ সড়কের আল বদর বাহিনী ক্যাম্প বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের পেছনে বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম জেনারেল পোস্ট অফিস বধ্যভূমি, সিআরবি নির্যাতন কেন্দ্র বধ্যভূমি, চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি, সার্কিট হাউজ (পুরান) বধ্যভূমি, বন্দর আর্মি ক্যাম্প বধ্যভূমি, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বধ্যভূমি, প্রবর্তক সংঘের পাহাড় বধ্যভূমি, সদরঘাট রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি ও ঝাউতলা বিহারি কলোনি বধ্যভূমি।
অবহেলিত নাথপাড়া বধ্যভূমি
দক্ষিণ কাট্টলীস্থ নাথপাড়া বধ্যভূমিতে সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো ২০২১ সালে। কিন্তু জাদুঘর নির্মাণের কোনো প্রকল্প এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এমনকি এখনো অবহেলিত অবস্থায় আছে এ ছোট্ট বধ্যভূমিটি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নাথপাড়া বধ্যভূমি সরেজমিনে দেখা যায়, সংস্কারহীন অবস্থায় পড়ে আছে জায়গাটি। দেওয়ালে লেখা শহীদদের নামগুলো প্রায় মুছে যাচ্ছে। পাড়ার ভেতরে ছয় ফুট প্রস্থের রাস্তার মোড়ে এটিতে পড়ে ছিলো ময়লা-আবর্জনা। স্মৃতিস্তম্ভে জন্ম নিয়েছে শেওলাসহ নানা পরজীবী উদ্ভিদ।
দেখা যায়, মধ্যম হালিশহরের নাথপাড়ায় বাদল নাথ, অনিল বিহারী নাথ, নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব, দুলাল কান্তি নাথসহ শতাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে বিহারিরা। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকায় কালের সাক্ষী এ জায়গাটিতে গড়ে ওঠেছে উঁচু উঁচু দালান। এমনকি নাথপাড়া জায়গাটির নামও বদলে হয়ে ওঠে মাইজপাড়া ও খুরশীদবাগ। ২০০১ সালে পাড়ার মোড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হলেও অধিকাংশ শহীদ পরিবার এখনো পায়নি কোনো স্বীকৃতি। স্মৃতিস্তম্ভে ঠাঁই পেয়েছে সমীরণ, সুনীল, নিশিকান্ত, প্রকাশ, অক্ষয়, শিউলী রাণী, বাদল, অনিলসহ ৪২ জনের নাম।
নাথপাড়ার স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, যুদ্ধের সময় দুই সন্তানের রক্তে ¯œান করানোর হয়েছিলো নিরবালা দেবীকে। তিনি বেঁচে নেই। তবে ঘরে রয়েছেন তার মেয়ে, ছোট ছেলেসহ পুত্রবধূ ও নাতি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর পুত্রবধূ বলেন, ‘এসব বলে লাভ কি? প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আপনারা আসেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সংস্থার মানুষ আসেন। কোনোকিছুই তো হয় না। আমার শাশুড়িকে তার দুই ছেলের রক্ত দিয়ে ¯œান করিয়েছিল। উনি এখন বেঁচে নেই। আমার ননদ পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচতে আগুনে ঝাঁপ নিয়ে পুরো শরীর পুড়ে ফেলেছিল।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অসংখ্যবার চিঠি চালাচালি করেছি। বধ্যভূমির একটি তালিকা করেছি। সেটি প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরেও দিয়েছি। আমরা আলোচনা তুললে একটু তোড়জোড় দেখি। কিন্তু পরে আবার সব থেমে যায়। এ কারণে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এরপরও আমরা আশা করি, এ সরকার আমাদের নিরাশ করবে না।’
বধ্যভূমিগুলো সংস্কার ও ইতিহাস সংরক্ষণের প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা গবেষক ড. মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চেতনাবোধের জায়গায় আমরা খুবই দুর্বল একটি জাতি। দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেও সব রাষ্ট্রীয় বা দেশের ইতিহাসের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল নই। সবাই এ বধ্যভূমি নিয়ে কথা বলে কেবল ডিসেম্বরেই। এরপর আর কারো কোনো খবর থাকে না। এভাবে ইতিহাস ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। এরপরও আমরা সরকারিভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করছি। ওটা শেষ হলে হয়তো কিছু ইতিহাস সবার সামনে ওঠে আসবে।’