একই সময়ে দুই শহরে গুলিবিদ্ধ বাদী!

সুপ্রভাত ডেস্ক »

গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়ে ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে রাজধানী ঢাকায় আহত হয়েছিলেন সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ সরকার। এ সময় চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ গুরুতরভাবে আহত হন তিনি। এ ঘটনায় গত ১৭ জুন সাইফুদ্দীন নিজে বাদী হয়ে নগরের খুলশী থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন।

এতে উল্লেখ করা হয় ৪ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে তিনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে একই ঘটনায় ঢাকার আদালতে গত ২০ মার্চ একটি মামলা করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয় ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় তিনি ঢাকার পরীবাগে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। একই দিন একই সময়ে একই ব্যক্তির দুই শহরে গুলিবিদ্ধ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের আসামি করাসহ নানা অসঙ্গতি ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খবর আমাদের সময়ের।

আইনজ্ঞরা বলেছেন, প্রত্যেক আইনেই মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষীর জন্য আলাদাভাবে শাস্তির বিধান আছে। তারা বলেন, একই সময়ে একই ব্যক্তি দেশের দূরবর্তী দুই শহরে আহত হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। মামলাটি কী কারণে করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা উচিত। পাশাপাশি হয়রানিমূলক মামলা না নেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও পুলিশ কীভাবে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই মামলা নথিভুক্ত করল, তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮২ ধারার অধীনে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো সরকারি কর্মচারীকে মিথ্যা তথ্য দেন, যা তাকে (সরকারি কর্মচারীকে) তার আইনানুগ ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্য কারও ক্ষতি বা বিরক্তির কারণ হতে পারে, তবে এটি একটি অপরাধ। এই ধারার অধীনে অপরাধের শাস্তি ৬ মাস পর্যন্ত কারাদ- বা জরিমানা অথবা উভয় দ- হতে পারে। এই ধারাটি মূলত সরকারি কর্মচারীর কাছে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে তাকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো বা কাউকে হয়রানি করা থেকে বিরত রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ও বিশিষ্ট আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান আমাদের সময়কে বলেন, ফৌজদারি দ-বিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে বিবাদী নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারেন। ওই ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলার বাদী বা সাক্ষীর দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- বা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ আমাদের সময়কে বলেন, এ ঘটনায় ঢাকায় যদি মামলা হয়, তাহলে আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদকে হত্যাচেষ্টার দুই মামলার এজাহারে সাইফুদ্দীনকে ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার আলিমের (উচ্চ মাধ্যমিক) ছাত্র হিসেবে উল্লেখ আছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নের কাচিয়াপাড় গ্রামে। বাবার নাম মো. বেলাল। সাইফুদ্দীন সরকারের গেজেটভুক্ত অতি গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত।

মামলার পদে পদে অসঙ্গতি : মামলা দুটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনার বিবরণ, ঠিকানাসহ এজাহারের পদে পদে রয়েছে ব্যাপক অসঙ্গতি। দুই মামলায় দুই ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকার মামলায় ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ২৬/২ তৃতীয় তলা তোপখান রোড, ঢাকা-১০০০। একই ঘটনায় চট্টগ্রামে দায়ের করা মামলায় ঠিকানা দেখানো হয়েছে শোলকবহর আল আমিন হাউজিং সোসাইটি, পাঁচলাইশ থানা, চট্টগ্রাম। এ ছাড়া ঢাকায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেখানে মেডিক্যাল সনদ না দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এমন কী, এ ব্যাপারে মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পায়নি ঢাকার শাহবাগ থানা পুলিশ।

ঢাকার মামলা : সাইফুদ্দীন মোহাম্মদ এমদাদকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গত ২০ মার্চ তার পক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি এমএ হাশেম রাজু। আদালত গত ৩০ এপ্রিল অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে শাহবাগ থানাকে নির্দেশ দেন। ওই অভিযোগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানাসহ ২০১ জনকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পপতি, শিল্পোদ্যোক্তা, সাংবাদিক, অভিনেতা, অভিনেত্রীও।

মামলায় অভিযোগ করা হয়- ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে মামলার বাদী এমএ হাশেম রাজুর নেতৃত্বে একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পরীবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের মোড়ে এসে পৌঁছে। তখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের অবরোধ করে। আসামিরা বাদী ও ভিকটিম সাইফুদ্দীনসহ ছাত্র-জনতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, হাতবোমা, পেট্রোল বোমা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় সাইফুদ্দীন মোহাম্মদ এমদাদ গুলিবিদ্ধ হন। এতে তার ডান চোখে ছররা গুলি ঢুকে পড়ে। তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে অজ্ঞাতনামা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ সদস্যরা মারধর করে, যা প্রত্যক্ষ করেন মামলার বাদী এমএ হাশেম রাজু। তিনি আহত সাইফুদ্দীনকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে ভর্তি করা যায়নি। পরে বাদীর সহযোগিতায় তাকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ আগস্ট তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন।

চট্টগ্রামে মামলা : গণ-অভ্যুত্থানে আহত হওয়ার ঘটনায় সাইফুদ্দীন মোহাম্মদ এমদাদ নিজে বাদী হয়ে গত ১৭ জুন চট্টগ্রামের খুলশী থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন। এতে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরসহ ১৬৭ জনকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় ব্যবসায়ী ও চারজন সাংবাদিক রয়েছেন।

এই মামলার এজাহারে সাইফুদ্দীন অভিযোগ করেছেন, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি আহত হন। এরপর চট্টগ্রামে চলে আসেন। ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নেন। ৪ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় জমায়েতে অংশ নেন। ১১টার দিকে সশস্ত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পাহারা দেওয়ায় সেখানে তিনি চিকিৎসা নিতে যাননি। আন্দোলনে অংশ নেওয়া চিকিৎসক, নার্স ও ইন্টার্নি চিকিৎসকদের কাছ থেকে নিরাপদ স্থানে চিকিৎসা নেন। তারা এমদাদের বুক ও বাম পা থেকে ছররা গুলির কিছু অংশ বের করেন। বাকি গুলিগুলো বুকে ও পায়ে থেকে যায়।

পরের দিন ৫ আগস্ট বুকে ও পায়ে ব্যথা নিয়ে নগরীর বাদুরতরা থেকে কারফিউ ভঙ্গের মিছিলে অংশ নেন সাইফুদ্দীন। মিছিলটি চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড় এলাকায় পৌঁছলে সশস্ত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। এতে তার মাথায়, পায়ে, মুখে ও চোখে গুলি লাগে। তিনি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। রাতে জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারেন তিনি চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরে স্বজনদের সহায়তায় বেসরকারি শেভরন হাসপাতালে চোখের অপারেশনের পর আবার চমেক হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে ১১ আগস্ট ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তার মাথা ও চোখ থেকে গুলি বের করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে ভর্তি হন। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি সেখান থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখনও তার ডান চোখের দৃষ্টি ফেরেনি। বাম চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে আসছে।

একই দিন দুই শহরে গুলিবিদ্ধ, তথ্যে অসঙ্গতি : দুই মামলার অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আদালতের নির্দেশে ঢাকার শাহবাগ থানায় লিপিবদ্ধ এজাহার অনুযায়ী সাইফুদ্দীন ৪ আগস্ট ঢাকার পরীবাগে গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনার ১০ মাস পর চট্টগ্রামের খুলশী থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় তিনি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ৫ আগস্ট একই নগরের ওয়াসা মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন, যাতে তার ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে খুলশী থানায় দায়ের করা মামলায় ঘটনাস্থল এবং আসামি করা নিয়ে কথা উঠেছে। ঢাকার মামলায় বলা হয়েছে, চোখে গুলিবিদ্ধ সাইফুদ্দীন সরকার পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট চমেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আর চট্টগ্রামের মামলায় বলা হয়, ৪ আগস্ট তিনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায় প্রথমে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরের দিন ৫ আগস্ট ওয়াসা মোড়ে আন্দোলন করতে গিয়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হন।

একই ব্যক্তির আহত হওয়ার ঘটনায় মামলার এজাহারের দুই ভাষ্য নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় দায়ের করা মামলার বাদী এমএ হাশেম রাজু বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট ঢাকার পরীবাগে আমার সামনেই চোখে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। তাকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিই। হাসিনার পতনের পর তাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, সাইফুদ্দীন মামলা করতে সমর্থ না হওয়ায় মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তার পাশে দাঁড়িয়েছি। তিনি আমাকে মামলা করার ক্ষমতা দিয়ে অ্যাফিডেভিট দিয়েছেন। আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। আমার মামলার এজাহারে যে বর্ণনা লিখেছি, তা সত্য। খুলশী থানায় তার দায়ের করা মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

মামলার এজাহারে দেওয়া সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের টেলিটক মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, কাউকে হয়রানির জন্য তিনি মামলা করেননি। তদন্তে দোষীদের নাম বেরিয়ে আসবে।

জানতে চাইলে খুলশী থানার ওসি আফতাব হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী একই ঘটনায় দুইটি মামলা হতে পারে না। আবার একই সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই জায়গায় আহত হওয়াও অবিশ্বাস্য। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়, বাদী মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকায় মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মুনসুর আমাদের সময়কে বলেন, আদালত আমাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছিলেন। আমরা এখনও প্রতিবেদন দাখিল করতে পারিনি। কারণ, ভিকটিমের মেডিক্যাল সনদ পাওয়া যায়নি। এই সনদ পেতে আমরা তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু সনদ দেননি। পরে তার ঠিকানায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার জবাবও মেলেনি। মেডিক্যাল সনদ পেলেই আমরা প্রতিবেদন দাখিল করব আদালতে।