সালাউদ্দিন এম মারুফ »
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জুসের কারখানায় গত বৃহস্পতিবার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ১২ বছরের শিশু শান্তা মনি অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে বুধবার নাম লিখিয়েছিল শ্রমিকের খাতায়। এর একদিন পর গত পরশু বৃহস্পতিবার বিকেলে নিখোঁজের তালিকায় তার নাম উঠে আসে। প্রথম দিন নিহতের তালিকায় থাকা ১৮ জনের মধ্যে অন্তত ১৪ জনই ছিল শিশু। সর্বশেষ ৫২ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এই শিশুদের শুরু না হতেই শেষ অংক দর্শন বড় বেদনাদায়ক। এদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। আমরা যারা বেঁচে আছি এই শিশুদের কয়েকগুণ আয়ু নিয়ে, ওরা আমাদের লজ্জায় ফেলে দিল। যে বয়সে যা করার কথা নয় বেঁচে থাকার শর্তে ওরা তাও করতে চেয়েছিল। ওদের সব চেষ্টা বিফলে গেছে। কেবল বেঁচে থাকাও কত কঠিন !
এই শিশুরা আমাদের সন্তান। এদের স্কুলে যাবার কথা ছিল। স্কুল বন্ধ। এদের ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার কথা ছিল না। আমরা ওদের জন্য ফ্যাক্টরিই খোলা রেখেছি। স্কুলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে। ফ্যাক্টরিতে কয়লা হবার ঝুঁকি থাকতে পারে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই !
আর কত কাঁদলে আমাদের শিশুরা ভাল থাকবে? শিশুরা ভালো নেই, এটা আমাদের কারো জন্য ভালো খবর নয়। শিশুরা ভালো থাকবে না, আমরা সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখবো। এ ও সম্ভব?
শিশুশ্রম বন্ধে কোভিড সময়ের আগে বাংলাদেশ অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও খুব ভালো কাজ করেছিল। স্কুলগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছিছল। এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। থোক টাকার ব্যবস্থা ছিল। কোভিড এসে সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি কোন এক সময় বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমো হোযুমি বলেছিলেন, “সবচেয়ে অসহায় শিশুদের জীবন, আশা-আকাঙক্ষা ও ভবিষ্যতের ওপর কোভিড-১৯ মহামারী বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্কুল বন্ধ ও পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অনেক শিশুর জন্য শ্রমে যুক্ত হওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।”তিনি আরও বলেছিলেন,“আমাদের এখন শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং মহামারীর পুরো সময়জুড়েই তা অব্যাহত রাখা উচিত।”
ইউনিসেফের সতর্কবার্তা আমাদের কোনো কাজে আসেনি। শিশুদের সুরক্ষা দেয়া ছাড়াও আমাদের আরো কাজ ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্বার্থে কল কারখানা চালু করতে হয়েছে। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করতে হয়েছে।কেবল শিশুরাই আমাদের চিন্তা ভাবনায় উপেক্ষিত থেকে গেছে।
কোভিড সময়ের আগেও ৪৭ লক্ষ শিশু, শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। এ সংখ্যা এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সে পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু রূপগঞ্জের জুসের ফ্যাক্টরিতে মৃতের পরিসংখ্যান আমাদের অন্তরআত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
এমন অবাধ শিশু শ্রমের চিত্র নিকট অতীতে ছিল না। যেকোন প্রতিকূলতার প্রথম শিকার হয় শিশুরা। আমাদের শিশুরা আগে থেকে পিছিয়ে। কোভিড এসে এবার পিষে দিয়ে গেল।
পশ্চিমা বিশ্ব শিশুদের উপেক্ষায় রেখে ভবিষ্যত শূন্যতায় নিপতিত হতে চায়নি। ওরা স্কুল কলেজ খোলা রেখেছে, যতটা সম্ভব।
ওদের দারিদ্র্যের সমস্যা নেই কিন্তু শিশু মাত্রই নিজে একটি সমস্যা। শিশুদের স্বাভাবিক অ্যাক্টিভিটি বন্ধ রাখা যায় না। ওদের খেলার জায়গা, মাঠ সব আমাদের এখানের মত ডাকাতদের দখলে যায়নি।
উনবিংশ শতকের শেষদিকে ম্যানচেস্টার শহরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ম্যানচেস্টার সিটি এই দুটি ক্লাব গড়ে উঠেছিল মূলত শিশুদের অশিশু সুলভ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে।
আমাদের এখানে শিশুদের জন্য কোন সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। দরিদ্র দেশের পরিকল্পনা ধনী দেশের মতো হবে, কথা নেই। আমাদেরকে আমাদের মত পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের শিশুরা পড়বে, কাজও করবে। ঝুকিমুক্ত কাজ, শিশু উপযোগী কাজ, বৃত্তি মূলক কাজ। কয়লা বানানোর কাজে না লাগালেই হলো।
আমাদের সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে, আমাদের সম্পদ সীমিত। আমরা এটা বুঝি। আমরা এও বিশ্বাস করি আমাদের দেশের উপযোগী একটি শিশুনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মোটেই কঠিন কিছু নয়।
সবার আগে প্রয়োজন মাইন্ডসেট-এর পরিবর্তন।‘সব ভাবনা সারা হলে শিশুদের নিয়ে ভাববো’-এটাকে উল্টে দিয়ে সবকিছুর আগে শিশুদের নিয়ে ভাবতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য এর বিকল্প নেই।
শুধু গল্প নয়, বক্তৃতা সেমিনার নয়, শিশুদের বুঝতে হবে হৃদয় দিয়ে। মনে রাখবেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত।
লেখক : প্রকৌশলী