রাজিব শর্মা »
চড়া দরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা কেনার পর বাজার দরপতনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা। হঠাৎ করে বাজারে ব্রয়লারের দাম কমে যাওয়াতে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না বলে তাদের অভিযোগ। এতে খামারিরা দুষছেন কর্পোরেট গ্রুপগুলোকে।
অভিযোগ রয়েছে, গত ঈদের (ঈদুল আযহা) আগে চড়া দরে বাচ্চা বিক্রি করেছেন কর্পোরেট সিন্ডিকেটরা। যার কারণে খামারিরা মুরগির বাজার নিয়ে পড়েছেন উভয় সংকটে।
প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। এরপরও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দাম ৪৯ থেকে ৫৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা আরও ভিন্ন। এই মুরগির বাচ্চা খামারিদের কিনতে হয়েছে ৭০ থেকে ১০০ টাকায়। আর খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ক্রয়সহ উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা। আর মে মাসের শেষে খামারিরা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন ১২০ টাকার নিচে। এতে খামারি পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ফলে খামার পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়েছেন অধিকাংশ খামারি।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চাঁন্দগাও কালুরঘাট, কর্ণফুলী মইজ্জারটেক শিকলবাহা এলাকার প্রায় ১৫ জন খামারির সঙ্গে কথা হয়। তারা বর্তমান ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ে হতাশাজনক মন্তব্য প্রকাশ করেন। অনেকেই লোকসানে পড়ে বাচ্চা মুরগি আর তুলছেন না বলে জানা গেছে। এমন অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে এ ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
লোহাগাড়া আর এম পোল্ট্রির মালিক মো. এরশাদুর রহমান বলেন, মার্চে আমাদের ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা শেডে তুলতে হয়েছে। একটি মুরগির বাচ্চা বিক্রিতে সরকারের পক্ষ থেকে ৪৯ থেকে ৫৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা থাকলেও আমাদের কিনতে হয়েছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকায়। আবার ফেব্রুয়ারিতে যেসব কিনছি তা কিনতে হয়েছে ৯০ টাকায়। পোল্ট্রি খাদ্য, ভেটেরিনারি চিকিৎসা খরচসহ সবমিলিয়ে প্রতি মুরগিতে কেজিপ্রতি খরচ পড়েছে প্রায় ১৫০ টাকার ওপরে। কিন্তু বর্তমানে মুরগির চাহিদা বাজারে নেই। আমাদের এখন পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। সবমিলিয়ে আমরা খামারিরা বড় লোকসানে আছি।
আর বাচ্চা মুরগি শেডে তুলবো না মন্তব্য করে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আজকের মুরগির বাজার নিয়ে এমন দশায় কর্পোরেট কোম্পানিরা দায়ী থাকবে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি একটু কম দরে মুরগির বাচ্চা কিনতে। সরকার বড় ব্যবসায়ীদের নির্ধারণ করে দিলেও তদারকি করেন নি। কিন্তু আমরা একটু বাড়তি দরে বিক্রি করলে সেটি ভালোভাবে নজরে রেখেছে। তাই এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি নতুন মুরগি আর খামারে তুলবো না।
সাতকানিয়া এলাকার পোল্ট্রি খামারি মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মুরগির বাচ্চার বাড়তি দর দেখে আমার ছয়টি খামারের মধ্যে এবার এক হাজার করে তিনটি শেডে তিন হাজার মুরগি তুলেছি, অনান্য তিনটি বন্ধ রেখেছি। মনে করছিলাম কোরবানের ঈদকে ঘিরে একটু লাভে বিক্রি করবো। এখন ঈদেও দুই সপ্তাহ আগেই মুরগির বাজারে দর নেমে গেছে। এখন প্রতি কেজি মুরগিতে আমি ২০ টাকা হিসেব করলেও প্রায় ৮০ হাজার টাকা লোকসানে আছি। এভাবে দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে খামার পরিচালনা করা সম্ভব না।
বিপিএ-র বক্তব্য
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এর সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বিবৃতিতে বলেন, ‘আকার, ওজন ও পরিবেশভেদে বর্তমানে প্রান্তিক খামারিরা মুরগি বিক্রি করছেন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। অথচ তাদের উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। এতে প্রতিটি মুরগিতে তারা ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনছেন। এ ক্ষতি কতদিন বহন করা সম্ভব? সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
প্রান্তিক খামারিরা সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছেন উল্লেখ করে মো. সুমন হাওলাদার আরো বলেন, ‘বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে, প্রান্তিক খামারিরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে খামারিরা ধীরে ধীরে উৎপাদন থেকে সরে যেতে বাধ্য হবেন। এর ফলে দেশের পোলট্রি খাত করপোরেট নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং সাধারণ জনগণ উচ্চমূল্যে মাংস ও ডিম কিনতে বাধ্য হবে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোম্পানির বাণিজ্যিক খামারের তুলনায় প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি এবং কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের তুলনায় ৩৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। অথচ কোম্পানিগুলো মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করেও তারাই পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ফলে প্রান্তিক খামারিদের বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।
সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মোট মাংসের চাহিদার শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ আসে পোলট্রি থেকে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের নানা লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করা প্রয়োজন। বর্তমানে মুরগির মাংসের অর্ধেকের বেশি আসে বাণিজ্যিক ব্রয়লার থেকে যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। কিন্তু বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পোলট্রি শিল্পের ওপর দৃশ্যমান। ফলে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় দেশি আবহাওয়া উপযোগী অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করা জরুরি। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ দেশীয় আবহাওয়া উপযোগী জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ধারাবাহিক সিলেকশন ও ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত সম্পর্কে আলোচনায় এনেছেন।
বাজারে মুরগির বাচ্চার দাম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নির্ধারণ করে দিলেও ঐ দরে কেন মিলছে না, এ বিষয়ে সংস্থাটির জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বলেন, প্রাণী সম্পদ বিভাগ পোল্ট্রিখাতে মুরগির বাচ্চার দর ৪৯ থেকে ৫৭ টাকা নির্ধারণ করলেও ঐ দরে বড় কোম্পানিরা বিক্রি করে নি। যার ফলে খামারিরা এইখাতে বিনিয়োগ করতে অনেকটা অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে। আবার এটাও ঠিক যে যখন বড় কোম্পানিরা মুরগির বাচ্চার দাম ১০ টাকা করে দেয়, তখনও আমরা দেখি খামারিরা মুরগির বাজারে তাদের চড়া দর অব্যাহত রাখে। এক কথায় বলা যায়, আমরা দর নির্ধারণ ও নির্দেশনা দিলেও উভয়পক্ষ মানেন না।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, পোল্ট্রিখাতে একটা স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসুক। এতে আমিষের ঘাটতি যেমন দূর হবে ঠিক তেমনি উঠতি খামারিরা মনোবল হারাবে না। এই বিষয়ে জনস্বার্থে খামারি ও বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উভয়কেই ভাবতে হবে। আর আমাদেও তদারকির বিষয় আমরা অব্যাহত রেখেছি। আমাদেও উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশমতে আমরা কাজ করছি।’
খামারিদের অভিযোগের বিষয়ে দেশের প্রথম সারির একটি কোম্পানির পরিচালক (নাম প্রকাশ না করার অনুরোধক্রমে) বলেন, ‘আমরা বরাবরই খামারিদের কাছে আন্তরিক। এক দিনের বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের ওপর নির্ভর করে। ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কম থাকলে খামারিরা বাচ্চা কিনতে চান না, তাই বাচ্চা মুরগির দামও কমে যায়। যখন ব্রয়লারের দাম বেশি থাকে, তখন সকল খামারিই বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ফলে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায় এবং বাচ্চার দামও বৃদ্ধি পায়।
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় এখন ব্রয়লারের দাম কম উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। গত বছর এক দিনের বাচ্চার দাম যখন বেশি ছিল হ্যাচারিগুলো বাচ্চার উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। ফলে বর্তমানে বাজারে সরবরাহ বেশি। যদি যোগসাজশ করে উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট থাকতো তা হলে উৎপাদন কখনো এত বেশি হতো না এবং দামও এত কম হতো না। বরং খামারিদের ভাবতে হবে তাদের মূল সমস্যা কোথায়।