শওকত আলী :
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালে। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধ যাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় তারা হলো আজকের পাকিস্তান। তারা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে চিরতরে বন্দি করে রাখতে, কিন্তু তা হলো না। এই প্রেক্ষপটকে কেন্দ্র করে সমকালীন ছড়াকার উৎপল কান্তি বড়ুয়া ‘ষোলই ডিসেম্বর’ ছড়ায় বলছেন :
অধীনতার হাতে
বন্দী দিনরাতে
অনেক দিনের পর
এলো একাত্তর
শক্ত এবার মন
করে মরণপণ
সাহস নিয়ে বুকে
ঘুরে দাঁড়ায় রুখে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমুখি হয় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে। পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসন হতে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। ভুট্টো শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত আহবানকে বুঝাতে ছড়াশিল্পী উৎপল কান্তি বড়ুয়া তাঁর ‘যুদ্ধজয়ের মাস’ ছড়ায় রূপ দিয়েছেন ‘দীপ্ত আহবান শেকলছেঁড়ার গান’ বলে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এই ভাষণে গোটাজাতি স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উত্তাল হয়ে ওঠে। সেদিন গর্জে ওঠা বীর বাঙালির কথাকে প্রকাশ করতে উৎপল বড়ুয়া তাঁর ‘স্বাধীনতা সূর্যের ছড়া’র মাধ্যমে বাঙালি জাতির রুখে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে চিত্রায়িত করেছেন :
মার্চের সেই কালো ভয়ানক রাতে
শত্রুর মোকাবেলা অস্ত্রহাতে,
প্রতিরোধ প্রাণপণে এগিয়ে চলা
বন্দুক-বারুদের গোলা হয়ে জ্বলা।’
এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মধ্যমে তারা ১৯৭১-এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাঙালিরা তখন পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল। বাঙালিরা যে বীরের জাতি তা বুঝাতে উৎপল কান্তি বড়ুয়া তাঁর ‘ষোলই ডিসেম্বর’ ছড়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন আঘাতের প্রত্যুত্তর:
আঘাত-প্রতিঘাত,
করলো বাজিমাত
নির্ভয়ে পথচলা,
শত্রুরা নিষ্ফলা।
উল্লসিত গান,
লক্ষপ্রাণের দান
সূর্যজয়ের ভোর
স্বাধীন একাত্তর।’
মে’র মাঝামাঝি সময়ে সকল বড় বড় শহরের পতন ঘটার মধ্যে দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান অংশ শেষ হয়। এই সামরিক আক্রমণ ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ত্বরান্বিত করে। এই গণহত্যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ করে তোলে। বাঙালিরা দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পরিণতিতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথকমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। দখলদার বাহিনীর হাত থেকে দেশ স্বাধীন, এটাকে বুঝাতে উৎপল বড়ুয়া তাঁর ‘স্বাধীনতা সূর্যের ছড়া’ উপস্থাপন করেছেন :
মনপ্রাণ বুক খুলে হেসে কথা বলা
পরাধীন শৃংখল টুটে পথচলা
পুবাকাশে টকটকে লাল জয়টিকা
স্বাধীনতা সূর্যের দীপ্ত এ শিখা।