জাহেদুল আলম »
‘‘তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়। তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে।’’ কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়ের হীরকোজ্জ্বল কৌতুকরস সম্পর্কে গুণমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
শ্রদ্ধার্ঘ্যটি স্মরণে আসার কারণ, সম্প্রতি ‘উল্টো থেকে’ নামক একটি রম্যগ্রন্থ পাঠের সুযোগ হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল কিন্তু সম্প্রতি বা এখন নয়, একত্রিশ বছর পূর্বে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৪ এপ্রিল ১৯৮৯ তে, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে। গ্রন্থকার আবদুল মালেক। প্রকাশক চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্থ কোহিনূর লাইব্রেরী। কোহিনূর লাইব্রেরী এখন বিলুপ্ত। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন রফিকুন্নবী (রনবী)।
গ্রন্থটির প্রচ্ছদও কেমন যেন উল্টো থেকে। গ্রন্থটিতে ষোলটি রম্য রচনা স্থান পেয়েছে। সেগুলোর কোনাটা গল্প, আবার কোনোটা গল্পচ্ছলে গদ্য রচনা। লেখাগুলোর অধিকাংশই সত্তর ও আশির দশকের বিষয় আশয় নির্ভর। এতে পাঠক সমাজ নির্মল আনন্দ উপভোগ ও বিদ্রƒপ দর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস -ঐতিহ্যেরও সন্ধান পাবেন। কোনো লেখা পড়ে মনে হয়েছে, এটা ষাটের দশকের শেষভাগে রচিত। যেমন, হাইওয়ান শার্ট (পৃষ্ঠা-৬৭), অথ বাস সমাচার (পৃষ্ঠা-৭১)। লেখাগুলোতে গ্রন্থকারের সূক্ষ্ম রসবোধ ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের সূচনা-রচনা ‘পিন সমাচার’ লেখাটিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্ট্রাপলার, স্কচ টেপ, জেমস কিøপ এসবের আগ্রাসনে এখনকার প্রজন্ম অবশ্য পিন এর ব্যবহার করেন না বললেই চলে। অথচ দেখতে সূঁই আর পেরাগের সংমিশ্রণ এই পিন এক সময় অফিস আদালত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা কাজে অপরিহার্য ছিলো। লেখক সেই সময়ে এই পিনের নানা রকম ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন রসিয়ে রসিয়ে পিনের হুল ফোটানো মেজাজে। লেখক পিন নিয়ে আর পিন দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রাচার ইত্যাদিকে হুল ফুটিয়ে শেষ করলেন এভাবে Ñ‘‘ সাম্প্রতিক কালের বিখ্যাত ছবি ‘অপুর সংসার’ দেখছেন। হঠাৎ দেখা গেল, সত্যজিৎ বাবু একটা নগণ্য হেয়ার পিনকে প্রাধান্য দিয়ে দিলেন। একটা হেয়ার পিন দিয়ে যদি অনেক কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হয়, তবে নগণ্য পিন দিয়েই বা নয় কেন?’’
গ্রন্থের দ্বিতীয় লেখাটিই উল্টো থেকে। মানে ‘উল্টো থেকে’ শিরোনামে। লেখাটির প্রারম্ভিকা-‘‘লোকে বলে, হায়রে কপাল। আমি বলি, আমার কপাল। হ্যাঁ, আমার না হয়ে কার আর হবে? রাস্তায় এককালে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, ধাবমান যন্ত্রদানব। আর এখন আমি তাতে চড়ি। ভিতর থেকে বাইরের চলমান লোক দেখি। তফাৎটা সেখানেই। যখন নিজে রাস্তায় হাঁটতাম তখন মনে হতো, সব গাড়িওয়ালা রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে। আর এখন গাড়ির মধ্যে বসে মনে হয়, তার ঠিক উল্টোটা। অর্থাৎ সব পথচারী ফুটপাত ছেড়ে রাস্তাটা দখল করে হাঁটছে। তাই, কি আর বলবো ! উল্টো থেকে দেখাটাই এখন আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।’’
পাঠক, আবদুল মালেক কিন্তু উল্টো থেকে দেখার ঘোষণা দিয়ে শুধু এই লেখাটি নয়, গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি লেখাতেই সোজাসাপ্টাভাবে সমাজের নানা গলদ, অসংগতি, রাষ্ট্রীয় গলদ, প্রাতিষ্ঠানিক গলদ, এমনকি ব্যক্তিগত দায়বোধ চিহ্নিত করেছেন।
ওই যে বঙ্কিমের রম্য রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে’Ñ এই গ্রন্থেও লেখক তা-ই করেছেন। গ্রন্থের শেষ লেখা ‘একটি সেমিনার ও বিরস ভবনা’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটি আরো সুখপাঠ্য করে তুলেছে রনবী’র অলঙ্করণ। প্রিন্টার্স লাইনে লেখা আছে প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ রফিকুন্নবী (রনবী)। পাঠক, খেয়াল করুন, রফিকুন্নবী লিখে ব্র্যাকেটে রনবী লেখা হয়েছে।
অলঙ্করণগুলো যতটা না রফিকুন্নবীর,তার চাইতেও বেশি রনবী’র। সাপ্তাহিক বিচিত্রার টোকাই এর কার্টুন অঙ্কনের মাধ্যমে সত্তর আশি ও নব্বইয়ের দশকে রনবী পাঠকদের মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে রেখেছিলেন। রফিকুন্নবী ওরফে রনবী’র অলঙ্করণে ‘উল্টো থেকে’ এর পৃষ্ঠাগুলো আকর্ষণীয় তো বটেই, আরো বক্তব্যধর্মী হয়েছে।
বইটি বাংলা রম্যসাহিত্যের একটি মূল্যবান সংযোজন। যদিও এর কোনো কপি এখন বাজারে নেই। আমরা আশা করব বইটি পুনমুদ্রিত হোক। এবং লেখক যেন আবার পাঠকদের সামনে আসেন।