রিজোয়ান মাহমুদ »
প্রথম কবিতার বই আনন্দ লোকের এক মহাযজ্ঞ, এক অমৃত আধার। গ্রন্থিত বইয়ে কোন টেক্স্ট কতটা কীভাবে আছে তা বিন্দুমাত্র জানবার আগ্রহ ছিলো না আমার। যা লিখেছি তা-ই কবিতা, যা অক্ষরের আলোয় ভরা উড়ন্ত ফড়িঙের ইশারা তা-ই মানুষের মুক্তির পয়গাম; এরকম ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম প্রায় সাত বছর দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, আমার লেখা আস্ত একটা গ্রন্থ মুদ্রিত হয়ে সৃজন বাজারে আসবে এটিই ছিল মৌলিক আবেগের বিষয়। যেন মহা অলৌকিক ক্ষমতা, আমি অদৃষ্ট শক্তি থেকে লাভ করেছি। ভাবনার খড়কুটো নিয়ে জীবনের প্রথম গ্রন্থ উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ আমি, চন্দ্রদেব।
লেখার তাগিদ অনুভব করেছি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন থেকেই । আমার বাবার সাময়িকীর পাতায় গল্প ও উপন্যাস পড়া এবং মেজো বোনের উপর্যুপরি উপন্যাস ও গল্পের পাঠ আমাকে উজ্জ্বল উজ্জীবিত করেছিলো। কিছুটা এলেমেলো সন্নাসব্রত জীবনের শিক্ষাও পেয়েছিলাম। সে-ই তখন থেকে লেখক হবার স্বপ্ন ছিল বেশি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা কীভাবে কীভাবে লেখা যায় এ-র নির্দিষ্ট কোন ছক আছে কি-না বুঝতে চাইতাম। একদিন হঠাৎ ছোট্ট একটা গল্পকাব্য লিখে ফেলি। ভেতরের ধরনটা অনেকটা গল্পের মতো উপরের আবরণ কবিতার ভাষায়ণ, অতঃপর, একটা নাতিদীর্ঘ রচনা। কয়েকজন বিশিষ্টজনকে দেখাতে তাঁরা নিরুৎসাহিত করলেন, তাঁদের পরামর্শ ; গল্পে কাহিনি লাগে, ক্লাইমেক্স লাগে, গল্পকে ঘিরে চরিত্রের বেড়ে ওঠা লাগে। গল্পে একজন প্রধান পুরুষ চরিত্র কিংবা নারী চরিত্র কখনো – সখনো আবশ্যক না হলে-ও, অনেকটা পালনীয় ধর্ম। গল্প মানে কাহিনির প্রয়োজনে কিছু চরিত্রের সমাহার। আর কবিতা শুধু কবিতাই, নিজের দেখা অভিজ্ঞতা ও কল্পনার কনকলতা নিয়ে নির্মিত হবে প্রতিটি গভীর ভাবের কবিতা। আমার কাহিনি ও ভাষা ছিলো এবড়োখেবড়ো। অতএব লেখার আগে পড়তে হবে। বিশিষ্টজনদের এই মতামতে যতটা না নিরুৎসাহিত হয়েছি ঠিক তারও বেশি মনের জোর ও শক্তি পেয়েছি। স্কুল পরীক্ষা দেব, পাঠ্য বইয়ের নিচে উপন্যাস ও কবিতা রেখে পড়েছি। বাবা সামনে আসলে পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে ফেলেছি সে-সব। স্কুলের পাঠ্যক্রম একদম ভালো লাগতো না। সাহিত্যের প্রতি এক অমোঘ টান উপলব্ধি করতে লাগলাম। কলেজে উঠে এটি আরও বেড়ে গেল।
কয়েকটি শিশুতোষ গল্প ও ছড়া দৈনিক জমানা ও স্বাধীনতা পত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো আজকের বিখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক ওমর কায়সারের বদৌলতে। তাঁকে পেয়েছি চট্টগ্রাম কলেজের একই সেকশনে বন্ধুরূপে। শুরু হয়েছিল দেদারসে ছোট গল্প ও ছড়া কবিতা লেখা। ট্রেনের গতির মতো চলছে সাহিত্যের দূর যাত্রা।
একবার কবি কাজল শাহনেওয়াজ ও ঔপন্যাসিক কামাল রাহমানসহ সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছি। পাহাড়র উচুতে নিজের অস্তিত্ব তুচ্ছ মনে হলে-ও পরক্ষনেই উপলব্ধি করেছি পৃথিবীর মানুষের নিকট আমার একখানা গ্রন্থ রয়েছে, যাতে মানুষের চিন্তার ভাবানুগতা আছে। নিম্নবর্গের মানুষের আবেগ অনুভূতি ও ভালোবাসার সবক আছে সেই গ্রন্থে।
১৯৯৬ সালের শেষের দিকে একটা লেখার ডায়েরি কবি হাফিজ রশিদ খানের হাতে তুলে দিই। কথা হয়েছিলো কবি হাফিজ রশিদ সম্পাদিত ুপুষ্পকরথ ু থেকে বেরুবে আমার প্রথম কাব্যনামা। এক অদ্ভুত অনুভূতিপ্রবণ মন সমাচ্ছন্ন দিন ও রাত । একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো, কবিদের প্রথম কবিতার বই সাধারণত আমি – তুমি -তে ভরা আনন্দ, প্রেম ও ভালোবাসার সিকস্তি থাকে। চটুলতা কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। অথচ আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ; ুউজানীনগরের কন্যারা” ছিল ঠিক তার উল্টো। প্রথামাফিক তারুণ্যের প্রেমের জায়গা থেকে সরে এসে আমার কবিতা ধারণ করেছে বাঙালি সংস্কৃতির নির্যাসমিশ্রিত জীবনবোধ। চিরায়ত সংবেদনশীল মানবিক বাঙালির দর্শন, ঐতিহ্য, লোকায়ত ও ইতিহাসের পথ ধরে উপমহাদেশের পুরাণকাহিনি।
এর কারণ ৯০ দশকে আমার উত্তর আধুনিক আন্দোলনে ঝুঁকে পড়া। এই আন্দোলনের দর্শন বা মূল মন্ত্রক ; কবিতার ইতিবাচক বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি। এভাবেই আমার প্রথম কবিতার বই উজানীনগরের কন্যারা প্রকাশিত হয়েছিলো এক বেদনা মথিত জীবনের সারমর্ম হয়ে।
কবিতা গ্রন্থ; উজানীনগরের কন্যারা
প্রচ্ছদ শিল্পী ; মনির মৃত্তিক
প্রকাশকাল ১৯৯৭
প্রকাশক ; পুষ্পকরথ
মূল্য ; ৩৫ টাকা























































