মোহছেনা ঝর্ণা :
ডাস্টবিনটার পাশে মানুষের জটলা দেখে ওসমান সাহেবেরও ইচ্ছে করছিল সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে। মানুষ আর রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো মিলে এত ঘনিষ্ঠভাবে জটলা পাকানোর রহস্যটা উদঘাটন করার কৌতূহল হলেও অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে এই ভাবনা মনে উসকানি দেয়ায় ডাস্টবিন ঘিরে এতগুলো মানুষের জটলা উপেক্ষা করেই কাঁধে খাবারের ব্যাগটা ঝুলিয়ে রিকশার জন্য এক কদম এক কদম করে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ তিনি হেঁটেই এলেন। হাঁটতে হাঁটতে দু’একবার যে তিনি কান খাড়া করে অন্যদের কথা শোনার এবং ঘাড় উঁচু করে ডাস্টবিনের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেননি তা নয়। তবে তাতে কোনো ফলপ্রসূ খবর তার কর্ণকুহরে ধরা দিল না। ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেই জীবন ত্রাহি ত্রাহি হয়ে যাওয়ার দশা, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র কিংবা রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্র হলে তাপমাত্রার পারদ কোথায় উঠবে কে জানে? হাঁটতে হাঁটতে ঘামে অর্ধেকটা গোসল হয়ে গেছে ওসমান সাহেবের।
রাস্তায় একটু শান্তি মতো হাঁটাও মুশকিল। এত চিপা চিপা রাস্তা দিয়ে একটার পর একটা এক্সিও, এলিয়ন আর প্রেমিও গাড়ি একদম কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে যাচ্ছে যে মনে হয় পারলে যেন ডলে দিয়ে যেত রাস্তায় হাঁটতে থাকা মানুষের মতো কীট-পতঙ্গদের। নিজেকে আজকাল কীট-পতঙ্গই মনে হয় ওসমান সাহেবের।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘড়িতে সময় দেখলেন ওসমান সাহেব। নয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। এখনো পঁচিশ মিনিট সময় আছে। তবে মনে হচ্ছে আজ লাল কালির দাগ খেতে হবে। লাল কালির দাগ যে আলকাতরার চেয়েও খারাপ চাকরি করতে না আসলে ওসমান সাহেব কখনোই অনুধাবন করতে পারতেন না।
শৈশব-কৈশোরে ওসমান সাহেবের আলকাতরা ভীতি ছিল। বছর দু’য়েক পর পর তাদের টিনের ঘরের চালে আর সিলিংয়ে আলকাতরা লাগানো হতো। আর বেখেয়ালে ওসমান সাহেব সেই আলকাতরার দাগ লাগিয়ে ফেলত জামায়। আর সেজন্য মার হাতে চেলা কাঠের কত মার খেয়েছে! প্রতিবার যখন মা মারতো মনে হতো আলকাতরার দাগের মতো জঘন্য বোধ হয় দুনিয়াতে আর কিছু নাই। অথচ এখন চাকরি করতে এসে প্রায় লাল কালির দাগ খেতে খেতে মনে হয় মার হাতের মার ঢের ভালো ছিল।
বড্ড একঘেয়েমি চাকরির জীবন ওসমান সাহেবের। মধ্যবয়সে এসে প্রায় তিনি ক্লান্তি বোধ করেন। মাঝে মধ্যেই ভাবেন যদি চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারতেন! আর ভাল্লাগে না। ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠে চার চারটি মুখের প্রতিচ্ছবি। যে মুখগুলো তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। যে মুখগুলোর জন্য তার প্রতিটা দিন বেঁচে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার স্ত্রী, পুত্র ,আর দু’কন্যা। তখন আর কোনো এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস হয়ে ওঠে না। বরং কিছুক্ষণ আগের ভাবনাগুলো বড় বেশি অবাস্তব, অবান্তর এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। সম্পর্কের সুতাগুলো বড্ড শক্ত। তা নাহলে শুধু সম্পর্কের মায়ার কারণেই কত মানুষ বয়ে বেড়ায় কত ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক জীবনের ঘানি। থেমে থেমে কত গোপন দীর্ঘশ্বাস এর বলয়ে কেটে যায় কতজনের দিবারাত্রি।
অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যথারীতি ১০ মিনিট লেট। এখনকার বস শাহরিয়ার সাহেব বেশ ভালো মানুষ। নিজেও অনেক দুঃখ, দুর্দশার প্রাচীর পেরিয়ে এই পর্যন্ত এসেছেন বলেই হয়তো অফিসের সবার জন্যই বেশ মায়া অনুভব করেন। কঠিন করে কোনো কথা যেমন বলতে পারেন না, তেমনি কঠিন কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না আর তাই বেশ ক’মাস ধরেই ওসমান সাহেবদের অফিসের হাজিরা খাতায় লাল কালির কোনো দাগ নেই। কেউ আসলে ইচ্ছে করে দেরি করে আসে না। কিন্তু যখন অনিচ্ছাকৃতভাবেই দেরি হয়ে যায় এবং তার জন্য চূড়ান্ত অপমান সূচক ব্যবহারে জর্জরিত হতে হয় বসের কাছে তখন কারো কারো জন্য সেটা প্রচ- যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। ওসমান সাহেব অবশ্য বিষয়টাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। শুধু আসা যাওয়া নয়, তাদের অফিসের কাজ-কর্মের ব্যাপারেও সবাই বেশ আন্তরিক। সবাই একটা বিষয় বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভাবে বস তাদের এত স্বাধীনতা দিচ্ছেন, এত সুবিধা দিচ্ছেন,তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হচ্ছেন, সে মানুষটা যেন তাদের কারণেই অন্যের কাছে ছোট হয়ে না যান।
ওসমান সাহেবের পাশের চেয়ারে বসেন নিজাম সাহেব। পাশাপাশি টেবিলে কাজ করার কারণে একজন অন্যজনের বেশ কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। যদিও ওসমান সাহেব বেশ ভালোই বুঝতে পারেন তাদের এই চাকরি জীবনে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় যাদের সাথে কাটানো হয় সময়ের নির্দিষ্ট কাঁটা পেরিয়ে যাওয়ার পর তারা কেউ কারো নয়। খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। অথচ নিদারুণ সত্যি।
ওসমান সাহেব অফিসে ঢুকেই দেখেন নিজাম সাহেব টেবিলের দিকে ঝুঁকে কি যেন লিখছেন। অন্যরাও যথারীতি যার যার কাজ করছে। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে রেখে বসের রুমে ঢুকলেন তিনি হাজিরা খাতায় সাইন করার জন্য। বস শাহরিয়ার সাহেব একটা ফাইল পড়ছিলেন। ওসমান সাহেবকে দেখে বললেন, কেমন আছেন ওসমান সাহেব?
জ্বি স্যার ভালো, স্যরি স্যার কোনো রিকশা পাচ্ছিলাম না, তাই দেরি হয়ে গেল। আজকাল ব্যাটারি রিকশা একদমই পাওয়া যায় না। শাহরিয়ার সাহেব একটু ম্লান হেসে বললেন, বসুন।
শাহরিয়ার সাহেবের মুখের মলিনতা চোখ এড়ায়নি ওসমান সাহেবের। তাই বললেন, স্যার কোনো সমস্যা?
শাহরিয়ার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা মানুষগুলো খুব খারাপ ওসমান সাহেব। আজ আবার ডিএমডি স্যার ফোন করে উইকেটের কথা মনে করিয়ে দিলেন। মনটা খুব অস্থির অস্থির লাগছে। হয়তো এজন্যই প্রবাদ বাক্য তৈরি হয়, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।
ডিএমডি স্যারের উইকেটের কথা শোনার সাথে সাথেই তল পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে ওসমান সাহেবের।
ওসমান সাহেবদের ডিএমডি স্যারের নাম মোল্লা সাদমান হাসান তালুকদার। কেউ মোল্লা স্যার ডাকে, আবার কেউ তালুকদার স্যার ডাকে, কেউ ডাকে জল্লাদ। তো সেই মোল্লা স্যারের আবার ক্রিকেট খেলা খুবই পছন্দ। জাতীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রায় সব ক্রিকেটেরই খোঁজ খবর রাখেন তিনি। চামচিকার দলদেরও তাই পছন্দে হোক, অপছন্দে হোক ক্রিকেটের খবর রাখতেই হয়। তা না হলে যে তাল মেলাতে পারবে না। ক্রিকেট খেলায় তার বেশি পছন্দ হচ্ছে উইকেট পড়ার দৃশ্য। মোল্লা স্যার তার সমস্ত প্রেম-প্রীতি ক্রিকেটের প্রতি ঢেলে দেয়ার কারণে তার অধস্তন কর্মীদের প্রতি ঢালার মতো আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। চাকরিতে কর্মী নিয়োগ করতে যেমন তিনি খুব বেশি সময় নেন না, চাকরি থেকে ছাঁটাই করতেও তেমন একটা সময় নেন না। বেশ কিছুদিন ধরে অফিসে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে মোল্লা স্যার নাকি একটা ক্রিকেট খেলার আয়োজন করবেন। এ খবরটা উড়ে উড়ে যখন ওসমান সাহেবের কানে আসে তখন তার গলাটা কেমন শুকিয়ে তীব্র দাবদাহে চৌচির হয়ে থাকা মাটির মতো চৌচির হয়ে যেতে চায়। একই দশা নিজাম সাহেবের, মনসুর সাহেবের, কাদের সাহেবের। একটু ভালো অবস্থা অবশ্য আওলাদ সাহেবের। ছাত্র জীবনে রাজনীতি করতেন, তাই মার খেয়ে যেমন অভ্যাস আছে তেমনি মার দেয়ারও অভ্যাস আছে। এই লোক খুব একটা ভয় টয় পায় না। দুশ্চিন্তা নামক শব্দটি এই লোককে কখনো আক্রান্ত করতে অন্তত অফিসের কেউ দেখেনি। মাঝে মাঝে অফিসের অনেকে শুধু কুচ পরোয়া নেহি এই ভাবের জন্য আওলাদ সাহেবকে হিংসা করে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
কলুর বলদের মতো খাটতে খাটতে কখন যে বেলা ডুবে যায়, দিনরাত, সকাল-সন্ধ্যা, আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির হিসাব নিকাশ পালটে যায় ওসমান সাহেব মাঝে মাঝে টেরও পান না ওসমান সাহেব।
যথারীতি প্রতিদিনকার চিরায়ত পিঁপড়ার সারির মতো লাইন ধরে সিটি সার্ভিসের গাড়িতে চড়ে বাসায় যখন পৌঁছেন তখন তার দেহের সবটুকু নির্যাস শেষে কেবল ছোবড়াটুকুই অবশিষ্ট থাকে। মাথায় যেন কিছু কাজ করে না। “আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভেতর স্বপ্ন নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে! স্বপ্ন নয়, শান্তি নয় , ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়। আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব কিছু তুচ্ছ হয়, প- মনে হয়, সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়, শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়!” জীবনানন্দ যে কীভাবে ওসমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ওসমান সাহেব নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না। আহ! একসময় কবিতাকে আশ্রয় করা মানুষটা এখন আর ওই পথ মাড়ানোরই সুযোগ পান না জীবন নামক রেলগাড়িটা টানতে গিয়ে।
বাসায় ঢোকার কিছুক্ষণ পরে ওসমান সাহেবের ছোট কন্যা ঊর্মি এসে বলল, জানো বাবা আজকে না কারা যেন ডাস্টবিনে একটা ছোট বাচ্চা ফেলে গেছে।
মেয়ের কথা শুনে ওসমান সাহেবের মনে পড়ল সকালবেলা অফিস যাওয়ার সময় তিনি গলির সামনের ডাস্টবিন ঘিরে মানুষের জটলা দেখেছিলেন। আশ্চর্য সারাদিনে একবারের জন্যও মনে পড়ল না ডাস্টবিন ঘিরে কৌতূহলী জনতার ভিড়ের কথা। ঊর্মি বলে, বাচ্চাটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বারবার চোখে পানি চলে আসছে। আচ্ছা বাবা, বাচ্চাটাকে ওরা আমাদের বাসার সামনে যদি রেখে যেত তাহলে তো বাচ্চাটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের বাসায় রেখে দিতে পারতাম। মানুষ খুব খারাপ, তাই না বাবা? মেয়ের মুখে কথাটা শুনে চমকে ওঠে ওসমান সাহেব।
রাত বাড়ে। ঘুমের আয়োজন সাঙ্গ হয়। ওসমান সাহেবের চোখে ঘুম আসে না। একটু পরপর গলাটা শুকিয়ে আসে। পানির পিপাসা লাগে। তলপেটে মোচড় দিয়ে ওঠে। বাথরুমে গিয়ে বসে থাকেন। পেট পরিষ্কার হয় না। চিনচিনে ব্যথা হয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। ঘুম আসে না। মাথার ভেতরটা কেমন বুদবুদ করতে থাকে।
এই মাঝবয়সে হঠাৎ চাকরিটা হারালে সংসার নামক চলমান গাড়িটা চলবে কীভাবে ভাবতে গিয়ে অস্থিরতায় ডুবে থাকেন। ডিএমডি মোল্লা সাদমান হাসান তালুকদারের শ্বশুর কাশেম আলীর নিজ হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠান। বড় স্যার এখন কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে আছে। বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকে। দুই ছেলে এবং দুই মেয়ের জামাই ই এখন কোম্পানির দায়িত্বে আছে। বড় ছেলে নামেই এমডি। ছোট ছেলে ডিএমডি। সম্প্রতি বড় মেয়ের জামাইকে ডিএমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনিই মূলত এইচ আর ডিভিশন এবং প্রশাসনিক দিকগুলো দেখেন। এই লোক দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই যে ওসমান সাহেবদের মানসিক যন্ত্রণার দিন শুরু হয়েছে তা আর কোনোক্রমেই কমছে না। বরং প্রতিদিন পুঁই শাকের আগার মতো একটু একটু করে বেড়েই চলছে।
অনেক বছর পাশাপাশি টেবিলে কাজ করতে গিয়ে নিজাম সাহেবের সাথে বেশ ভালো একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে ওসমান সাহেবের। দুজনেই মধ্যজীবনে এসে সন্তান, সংসার আর চাকরির ফ্যাসাদ নিয়ে অথৈ সমুদ্রে খাবি খাওয়ার দশা। রাতে তাই নিজাম সাহেবকে ফোন দিয়ে একটু দুঃখ ভাগাভাগি করতে চান ওসমান সাহেব। দুই হতাশবাদী কিছুক্ষণ হা হুতাশ করে পরদিন আবার রুটিন মাফিক জীবনের ঘানি টানতে শুরু করে। আজ অবশ্য নিজাম সাহেব বলেছে, বড় দুর্দিন সামনে। নতুনদের জোয়ারে আমরা বেসামাল। মোল্লা স্যার কিন্তু লিস্ট ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। একাডেমিক ডিগ্রীটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
একটু সুখ – দুঃখ ভাগাভাগির জন্য ফোন করেছিলেন ওসমান সাহেব। কিন্তু নিজাম সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে ফোন করাটা উচিত হয়নি। একটা নিশ্চিত খুঁতের কথা এই রাত্রে হয়তো এমনিতে মনে পড়তো না।
ওসমান সাহেবের স্ত্রী সেলিনা স্বামীর চেহারার দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারেন এই লোক কী ভাবছে।ছাব্বিশ বছরের জার্নিতে পলকে পলকে তিনি এই লোকটাকে পড়তে পারেন। কখনো কখনো খুব মায়া হয়। কখনো কখনো খুব বিরক্তি লাগে তার। দুনিয়ায় কত সমস্যা আছে, কত আনন্দ আছে আর এই লোককে গত ছাব্বিশ বছর ধরে তিনি দেখে আসছেন দুশ্চিন্তার ক্ষেত্রে এই এক বিন্দুতে স্থির থাকতে।
দূরে কোথায় যেন গগনবিদারী চিৎকারে খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে রাতের নিরবতা। ওসমান সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকান। কে এমন কাঁদছে এত রাতে? সেলিনা ও পাশে এসে দাঁড়ায়। আকাশে ভেসে থাকা অর্ধচন্দ্র মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। হিমহিম একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে। প্রকৃতি খুব উল্টাপাল্টা আচরণ করছে ইদানীং। প্রায় প্রতিরাতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে ওঠার পরেই দেখা যায় গনগন করা সূর্যের তাপ। টানা বৃষ্টিতে ঘরের মেঝে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে কিন্তু গরমের তীব্রতা কমে না। ফ্যানের বাতাসও মাঝে মাঝে এত গরম লাগে যে মনে হয় লু হাওয়া বইছে।
সেলিনা ওসমান সাহেবকে ঘুমানোর জন্য ডাকে। যদিও জানে আজ আর সারারাত এই লোক দু’চোখের পাতা এক করবে না। একটা মানুষ এত মানসিক চাপ কীভাবে নিতে পারে সেটাই মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে সেলিনার। শুধু চাকরি বিষয়ক দুশ্চিন্তা নয়, সেলিনার মনে আছে তাদের বিয়ের পর যখন এই শহরে প্রথম সংসার শুরু করতে হয় গ্রামের সবাইকে রেখে একা একা তখন ওসমান সাহেব টেনশন করত সেলিনা সারাদিন একা বাসায় কীভাবে থাকবে? এই অচেনা শহরে কোনো আপনজন নেই, কোনো বিপদ আপদ হলে কে দেখবে! এরপর যখন তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হবে ওসমান সাহেব ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতেন কখন না জানি সেলিনার ব্যথা শুরু হয়ে যায়, যদি অনেক রাতে ব্যথা শুরু হয় তখন তিনি কী করবেন? বড় মেয়েকে প্রথম স্কুলে দেয়ার সময়ও নানা রকম দুশ্চিন্তা। স্কুলে কে আনা নেয়া করবে? মেয়ে কীভাবে রাস্তা পার হবে? সেই মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু ওসমান সাহেবের টেনশন কমে না।
সেলিনা ধরেই নিয়েছেন এই ভদ্রলোক টেনশন যুক্ত মানুষ। টেনশন ছাড়া এই লোক অসম্পূর্ণ। কিন্তু মাঝে মাঝে এত মায়া হয় যে ইচ্ছে করে এই মানুষটাকে সব টেনশন থেকে মুক্ত করে একটা ফুরফুরে জীবন দিতে। কিন্তু কিছুই করা হয় না সেলিনার। আর তাই দেখে যাওয়া ছাড়া এবং সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার। তবে নিজে থেকে কখনো কোনো সাধ আহ্লাদের কথা বলে বাড়তি চাপে ফেলতে চাননি সেলিনা ওসমান সাহেবকে।
রাতে নির্ঘুমই থাকেন ওসমান সাহেব। তাই সকালে চোখে লেগে থাকে ক্লান্তির ছাপ। অফিসে যেতে অবসাদ লাগে। কিন্তু না যেয়েও স্বস্তি নেই। কখন কী হয়ে যায় অগোচরে! রাস্তায় নেমে রিকশার জন্য দাঁড়াতেই দেখেন সামনের দুটা বিল্ডিং পেরিয়ে হালকা আকাশি রঙয়ের বিল্ডিংটার সামনে একটা শববাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একই পাড়ায় থাকা মানুষ, তবু কেউ কাউকে চেনে না, জানে না এই অনুভবটা মনটাকে খুব পীড়া দেয় ওসমান সাহেবের। ইচ্ছে করে জানতে কে মারা গেল! কখন মারা গেল? কী হয়েছিল? ইচ্ছেগুলোকে পাথর চাপা দিয়ে রোবটের মতোই রিকশার জন্য দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘেমে নেয়ে যাওয়ার অবস্থা হলে তিনি হাঁটতে শুরু করবেন সামনের দিকে এমন সময় তাদের বাসার সামনের দোকানদার রফিক আসছিল ভেতর থেকে। রফিককে জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেছে?
রফিক জানালো আকাশি রঙয়ের বিল্ডিং এর তিনতলার ভাড়াটিয়ার বড় মেয়েটা কাল রাতে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁসি খেয়েছে।
ওসমান সাহেব বিমর্ষ হয়ে রিকশার জন্য হাঁটতে থাকেন। জীবন কত ঠুনকো হয়ে গেছে এখন। আগে কালে ভদ্রে হঠাৎ হঠাৎ কোন দূরের পৃথিবীতে শোনা যেত আত্মহত্যার কথা। আর এখন পান থেকে চুন খসলেই আত্মহত্যা। খুন- খারাবি এগুলো এখন ডালভাতের মতো নিত্যদিনকার খবর। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই গ-ায় গ-ায়, ডজনে ডজনে খুনের খবর। আর রানা প্লাজা, কিংবা তাজরীন গার্মেন্টস এর ট্র্যাজেডি হলে এক দিনেই শত শত মৃত্যুর খবর। দু’চারদিন গেলে সে সংখ্যা হাজারের ঘর পেরিয়ে যায়। প্রতিদিনকার সড়ক দুর্ঘটনায় দু’চারটা মৃত্যুর খবর না হলে পথ যাত্রা যেন শুদ্ধ হয় না। আছে লঞ্চডুবি, পাহাড়ধসের মতো ঘটনাও। আর নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন এগুলা তো আছেই। জীবন কত মূল্যহীন। এই বাজারে সব কিছুর দাম বাড়ছে, চাল, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, মরিচ, সবজি, শুধু কমছে মানুষের দাম। মানুষ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে মূল্যহীন। যার মন চায় সে গাছের দু’একটা ডাল ভাঙার মতো কিংবা দু’একটা পিঁপড়া মারার মতো দু’একটা মানুষ খুন করে ফেলে চোখের পলকে।
ওসমান সাহেব অফিসে ঢুকে দেখেন কাদের সাহেব হাউমাউ করে কাঁদছে নিজের চেয়ারে বসে। তারপাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্যরা। বস শাহরিয়ার সাহেব মলিন মুখে কম্পিউটার এর মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওসমান সাহেব কিছু না বুঝে উঠতেই নিজাম সাহেব পাশে এসে বলল, উইকেট একটা পড়ে গেছে ভাই। কাদের সাহেবের চিঠি এসেছে। নিজাম সাহেব আরো কী কী যেন বলে যাচ্ছিল, ওসমান সাহেবের কানে ঠিক স্পষ্ট ভাবে ঢুকছিল না। কারণ ওসমান সাহেবের বুকটা ধড়ফড় করছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। ওসমান সাহেবের মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা দুলছে।
ডা. ওসমান সাহেবকে এক সপ্তাহের বেড রেস্ট দিলেন। প্রেশার হাই। ডায়াবেটিস বেশি। ঘুমের জন্য ওষুধ দিলেন। সেলিনা ওসমান সাহেবকে বলছে, ধরো তোমার চাকরিটা চলে গেল, কী হবে? কষ্ট হবে। স্বাভাবিক জীবনটা ব্যাহত হবে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সমস্যা হবে, তাই না? কিন্তু তুমি যে আর্থিক বেনেফিট পাবে তার সঙ্গে আমরা ভেবেচিন্তে কোনো না কোনো ভাবে উপায় তো বের করতে পারব জীবনটাকে কীভাবে চলমান রাখা যায়, তাই না? আর সবচেয়ে বড় কথা আগামীকাল কী হবে তা তো আমরা কেউ জানি না। তাহলে কেন এত চাপ নেয়া? আগামীকালকের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আমার আজকের জীবনের স্বস্তিটুকু ধূলায় মিশিয়ে দেয়ার তো কোনো মানে হয় না। আগামীকাল তো আমি, তুমি কিংবা আমরা বেঁচে নাও থাকতে পারি। তখন কী জীবন থেমে যাবে? নাকি থেমে গেছে কারো? তাহলে এত এত দুশ্চিন্তার ভার কেন বহন করতে হচ্ছে দিনের পর দিন? আরে যেখানে মানুষই বেঁচে থাকছে না সেখানে চাকরি তো অতি ক্ষুদ্র বিষয়।
সপ্তাহখানেক পরে সুস্থ হয়ে ওসমান সাহেব অফিসে গিয়ে শোনের নিজাম সাহেবের নামে চিঠি এসেছে। নিজাম সাহেবের তো হার্ট এটাক হয়ে যাওয়ার দশা। পরে ইন্নালিল্লাহ পড়তে পড়তে চিঠি খুলে তার চক্ষুচড়কগাছ। পদোন্নতির চিঠি। দীর্ঘ নয় বছর পর পদোন্নতি। যেখানে চাকরিটাই যাই যাই করছে আর সেখানে কি না পদোন্নতি!! বিশ্বাসই হচ্ছিল না নিজাম সাহেবের। এও সম্ভব! নিজাম সাহেবের চিঠি আসার পর এবার সবাই ভয়ের পাশাপাশি কিছুটা স্বপ্নও দেখে সঙ্গোপনে। তবে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার আশংকা স্বপ্নের জানালায় খুব বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। চিঠি আসার খবর মানেই নাকের গোড়ায় নিশ্বাস আটকে থাকা।
নিজাম সাহেবের চিঠি আসার পর মাসখানেক চিঠি বিষয়ক আলাপ- আলোচনা বন্ধ ছিল অফিসে। সবাই ভাবছিল যাক এ বছরটা হয়তো টিকে গেল তারা। মনটাকে কিছুটা শান্ত করে দৈনন্দিন রুটিন কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করে যায়।
এরপর প্রায় দু’মাস পর অফিসে আরেকটা চিঠি এসেছে। ওসমান সাহেব অফিসে যাওয়ার পর বস শাহরিয়ার তাকে রুমে ডেকে চিঠিটা হাতে দিলেন। হেড অফিস থেকে নামে নামে পাঠানো চিঠিতে লালকালিতে বড় করে লেখা থাকে “কনফিডেনসিয়াল”। তাই যার চিঠি তিনি খোলার আগ পর্যন্ত বোঝার উপায় নাই কীসের চিঠি। চিঠির কথা শুনেই ওসমান সাহেবের তলপেটে মোচড় দিয়ে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসল। ওসমান সাহেব যখন হাত বাড়িয়ে চিঠি নিলেন বসের হাত থেকে ওসমান সাহেবের মনে হচ্ছিল তার বুকের বামপাশের ঘড়িটা ঢং ঢং করে বাজছে। এসি ঘরেও ওসমান সাহেব ঘেমে ভিজে যাচ্ছেন দরদর করে। চিঠিটা খুলতে গিয়ে দেখলেন তার হাত কাঁপছে।