হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামীন, আহ্কামুল হাকিমীন’র জন্য সমস্ত হামদ্ ও সানা, যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি এক মুমিন মুসলমানের জন্য অপর মুমিনের জানÑমাল ও সম্পদ হারাম করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, যিনি আমাদেরকে শান্তি, নিরাপত্তার ধর্ম, ইসলামের জীবন ব্যবস্থা দান করে কৃতার্থ করেছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক বা সমকক্ষ নেই। আমাদের মত পাপীÑতাপী উম্মতের কা-ারী শফিউল মুযনিবীন সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।
মাহে মুহাররমের এখন তৃতীয় দশকে আমরা উপনীত। দেখতে দেখতে শাহাদতের খুন রাঙা, কারবালার বিয়োগান্তক, মর্মন্তুদ স্মৃতিবহ মাসটি ক্রমশ বিদায় নিচ্ছে। কালের গতিপ্রবাহ আমাদের সবাইকে বিদায়ের জন্য প্রস্তুতির প্রাত্যহিক সংকেত দেয়। মাস গত হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ঘটনার স্মৃতিচর্চা ক্রমশ থেমে যায়। যেটুকু সুযোগ হয়, আমাদের ঈমানী শক্তির নিয়ামক ঘটনাবলি চর্চা করে দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে সচেষ্ট হতে পারলে নিজেদেরই মঙ্গল, নিঃসন্দেহে। উত্তম আদর্শের চর্চাও যেমন আমাদের সে আদর্শে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি বিপরীতে মন্দজনের কুখ্যাতি মনে রাখলে তা থেকে দূরে থাকার মনোবলও অর্জিত হতে পারে। কারবালার ট্র্যাজেডি নবীÑপরিবারের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও তাঁরা সত্যের মহিমা সমুন্নত রাখতে আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে প্রজন্মের কাছে সশ্রদ্ধে স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে আছেন। পক্ষান্তরে, ইয়াযীদিদের ঘৃণ্য তৎপরতা, নাশকতার স্মৃতি অপরাধকে ঘৃণা করতে প্রাণশক্তি যোগায়।
মহান ¯্রষ্টা প্রতিযুগের বিশ্বাসী, ন্যায়Ñপরায়ণ বান্দাদের চরম বিপদে হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রাণপণ সংযমের হুকুম দিয়েছেন। ধৈর্যশীল বান্দাদের প্রতি তার প্রতিদানেরও সুসংবাদ দেন। তাঁর ইরশাদ, ‘হে নবী আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। তাঁরা, যখন তাঁদের প্রতি কোন মুসীবত আপতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য আর সবাই তো আমরা তাঁরই প্রতি প্রত্যাবর্তনকারী। (২:১৫৬) আল্লাহ্র শেখানো ধৈর্যশীল বান্দাদের এ অপূর্ব সমপর্ণের স্বীকারোক্তি যে কতটা সত্যানুরাগ জাগানো প্রেরণাবাক্য, আত্মসমর্পিত বান্দামাত্র তা উপলব্ধি করে।
ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.) ও তাঁর পরিবারের পবিত্র সদস্যবর্গ, আর মুষ্ঠিমেয় অনুসারী ভক্তের ছোট্ট কাফেলা অসম মোকাবেলায় বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে প্রায় সবাই শহীদ হন। শাহাদতের পরেও তাঁদের প্রতি নির্দয় ইয়াযীদি সৈন্যদের অত্যাচারের ঘৃণ্য আচরণ সর্বকালের মানবতাকে লজ্জায় অধোবদন করে দেয়। তারা দুনিয়ার লোভ লালসায় একথাও ভুলে যায় যে কার সাথে তারা এমন দুর্ব্যবহার করছে, ভাবছেও না এর পরিণাম কী? তারা ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.) ও তাঁর পবিত্র আওলাদবর্গ এবং শুভাকাক্সক্ষী সফরসঙ্গীদের শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁদের পবিত্র লাশগুলোর সাথে এতই লোমহর্ষক, বর্বরোচিত অত্যাচার, নিপীড়ন চালায়, তা কোন মুসলমান কোন যালিম অমুসলিমের সাথেও করতে পারে না। ইমামে পাক ও তাঁর সঙ্গীÑসাথীদের কর্তিত শিরমোবারক আহলে বাইতের পূরনারী ও একমাত্র কিশোর যয়নুল আবেদীনসহ ইবনে যিয়াদের দরবারে আনা হল। পথিমধ্যে অনেকগুলো অভিনব ঘটনা ঘটেছে। ইবনে যিয়াদের দরবার বসল। প্রজা সাধারণের উপস্থিতিতে তাঁদের কেটে শিরগুলোর জনসমক্ষে প্রদর্শনী দেওয়া হল। নবীÑদৌহিত্র, শহীদকুল ইমাম হুসাইনের (রাদ্বি.) শির মুবারক আলাদা এক রেকাবীতে রাখা হল। যালিম ইবনে যিয়াদের হাতে ছিল এক ছড়ি। সে ছড়ি দিয়ে হতভাগ্য ইমাম হুসাইন’র (রাদ্বি.) পবিত্র ঠোঁটে, দাঁত মুবারকে টোকা দিতে দিতে বলছিল, ‘এমন সুন্দর ও আকর্ষণীয় মুখ আমি দেখিনি’। সেখানে উপস্থিত নবীজির প্রবীণ সাহাবী যায়েদ বিন আকরাম (রাদ্বি.) এ দৃশ্য দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন। শোকে, দুঃখে, ক্ষোভে তিনি কেঁদে উঠে বললেন, ‘রে মারজানার পুত্র, মুবারক ওই ঠোঁটজোড়া হতে ছড়িটা সরাও। খোদার কসম, যিনি ছাড়া আর উপাস্য নেই। আমি নিজের চোখে রাসুলে আকরাম (দ.) সে জায়গায় কতবার চুমু খেতে দেখেছি’। বলেই তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকে ধমকে উঠে বলল, ‘খোদা তোমাকে আরো বেশি কাঁদাবে। বার্ধক্যে তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি যদি লোপ না পেত, তবে আমি তোমার মাথা থেকে গর্দান অবশ্যই পৃথক করে দিতাম’। (সাওয়াকে মুহরিকা সূত্রে)
এরপর ইবনে যিয়াদের সামনে আহ্লে বাইতের অবশিষ্ট কাফেলাকে আনা হল। সায়্যিদা যয়নব (ইমামের সহোদরা) রাদ্বি. ঝিÑবুয়াদের মত জীর্ণ পুরোনো, ময়লা পোশাক পরিহিত ছিলেন। ইবনে যিয়াদ বারবার পরিচয় জানতে চাইলেও তিনি কোন উত্তর দেননি। উপস্থিত কোন মহিলা বলে দিল, ‘ইনি যয়নব বিনতে ফাতেমা।’ শুনে সে বলে ওঠল, আল্লাহ্র শোকর, যিনি তোমাদের লাঞ্ছিত ও নিহত করলেন’। শুনে তিনি উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ্র শোক্র, তিনি আমাদেরকে হযরত মুহাম্মদ (দ.)র বদৌলতে সম্মানিত করেছেন। তিনি তাঁর ইচ্ছায় আমাদেরকে পবিত্র করেছেন। তোমার কথা সঠিক নয়; বরং দুরাচাররাই লাঞ্ছিত হয়’। সে বলল, দেখলে তো আল্লাহ্ তোমাদের পরিবারস্থদের সাথে কেমন আচরণ করলো। তিনি বললেন, ‘তাঁদের ভাগ্যে শাহাদতই নির্ধারিত হয়ে গেছে। এক ফাঁকে ওই যালিমের চোখ হঠাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন’র ওপর পড়ল। সে জানতে চাইল, তোমার নাম কী? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আলী ইবনে হুসাইন’ সে বলল, খোদা কি আলী ইবনে হুসাইনকে শেষ করেন নি?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমার আরেক ভায়ের নামও আলী, তোমাদের লোকেরা তাঁকে শহীদ করেছেন। সে বলল, ‘না, আল্লাহই শেষ করেছেন।’ এরপর ইবনে যিয়াদ তাঁকেও কতল করার হুকুম দেয়। সায়্যিদা যয়নব হাহাকার করে ওঠলেন। তিনিও গর্জে ওঠে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর, নবী বংশের এই শেষ চিহ্নটা বাঁচতে দাও। না হয় আমাকেও শেষ করে দাও। ইমাম যয়নুল আবেদীনের মুখে ভয়ের চিহ্নটুকু ছিল না। বললেন, আমাকেও যদি হত্যা করোই, তবে বংশের মর্যাদার খাতিরে বলছি, ‘এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে এ মহিলাদের সসম্ভ্রমে মদীনায় পৌঁছে দিও’। কিন্তু অজানা কোন কারণে কিশোর ইমামকে হত্যার সিদ্ধান্তকে সে বদলে ফেলে ইমামে হুসাইন (রাদ্বি.)র কর্তিত শির মুবারকের সাথে অনুরূপ আচরণ করেছিল দুরাচার ইয়াযীদও। ইবনে যিয়াদ পরে শিমার, খোলী, যাহ্রবিন কায়স’র মত নরাধম, হায়েনাÑচিত্ত একটি টিমসহ মজলুম কাফেলা ইয়াযীদের দরবারে পাঠিয়ে দেয়। সে সময় কিশোর ইমাম’র হাতÑপা ও কচি গর্দান ছিল শিকলে বাঁধা, পবিত্র মহিলারা ছিলেন উটের খোলা পিঠে বসা। খোলা দরবারে ইয়াযীদ যখন ইমাম হুসাইন (রাদ্বি.)র দাঁতমুবারক ও ঠোঁটে ছড়ি দিয়ে মৃদু আঘাত করত রসিকতাও করছিল, তখন সেখানেও প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন অপর এক সাহাবীয়ে রাসূল হযরত আবু বোরযা আসলাম (রাদ্বি.)। যুগে যুগে ইয়াযীদিরাও যেমন থাকে, সংখ্যালঘু হলেও থাকেন প্রাণ প্রতিজ্ঞ হুসাইনীরাও। ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বা’দ।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।