মৃত্তিকা সহিতা »
গত শতকের গোড়ায় ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের ভাওয়ালের ‘মেজোকুমার’ বা ‘সন্ন্যাসীরাজা’কে ঘিরে যে অবিস্মরণীয় ঘটনা প্রবাহ উদ্ভূত হয়েছিল, ইতিহাসে তার নজির মেলা ভার। ১৯০৯ সালে দার্জিলিংয়ে রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ‘কথিত’ রহস্যজনক প্রাণত্যাগ, এক যুগ পর সন্ন্যাসীবেশে আগমন, জমিদারির অধিকার নিয়ে দীর্ঘ ও তিক্ত মামলা, শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের অব্যবহিত পরেই ১৯৪৬ সালের মধ্যভাগে আকস্মিক মৃত্যুু প্রায় চার দশকব্যাপী চলমান এই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা কেবল বাংলা নয়, আলোড়ন তুলেছিল ভারতজুড়ে; এমনকি ঔপনিবেশিক শাসককুল কেন্দ্র লন্ডনেও তার ঢেউ পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। ফলে অস্বাভাবিক নয় যে, শতাব্দীকালের অধিক অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এখানকার জনমানসে ভাওয়াল রাজার কাহিনী নানান রূপে আজও প্রবলভাবেই উপস্থিত। এই ঘটনাকে উপজীব্য করে বিগত দশকগুলোতে রচিত একাধিক প্রকাশনা ও মঞ্চ-চলচ্চিত্রসহ নানান মাধ্যমে উপস্থাপন তারই সাক্ষ্য দেয়। এই ধারারই সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন ২০২২ সালে চধহ গধপসরষষধহ ওহফরধ কর্তৃক প্রকাশিত সুলেখিকা অরুণা চক্রবর্তীর উপন্যাস দ্য মেন্ডিক্যান্ট প্রিন্স।
একটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসটিতে প্রাসঙ্গিকভাবেই আবর্তিত হয়েছে সমসাময়িক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত। অরুণা চক্রবর্তী তাঁর অনুধ্যানী গবেষণার মধ্য দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ভাওয়াল রাজাদের পূর্বাপর ইতিহাস, সন্ন্যাসী রাজার আগমনের ফলে রাজপরিবার ও স্থানীয় লোকালয়ের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব, এবং ভাওয়াল রাজার মামলার কৌতুহলোদ্দীপক খুঁটিনাটি বিবরণ। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, শরৎ পুরস্কারসহ অন্যান্য সম্মাননায় ভূষিত অরুণার স্বাদু গদ্যের মুনশিয়ানায় নানা ঘটনায় ভারাক্রান্ত ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাসটি এক মুহূর্তের জন্যও পাঠককে শুষ্ক কঠিন তথ্য-তত্ত্ব-বিশ্লেষণের ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে না। বরং, উপন্যাসের প্রতিটি পাত্র-পাত্রী ঘটনাবলীর জটিল আবর্তের মধ্যেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও মানবীয় অনুভবে বাক্সময়। যেহেতু উপন্যাস, ফলে ক্ষেত্রবিশেষে তিনি লেখকের স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বটে, তবে তা কোথাও ইতিহাসের মূল ধারাকে ছাপিয়ে যায়নি।
আগেই বলেছি, এই উপন্যাসের চরিত্র, ঘটনাবলী, এমনকি পরিণতি সবটাই অনেককাল ধরেই এ অঞ্চলে বহুচর্চিত। লেখিকার কৃতিত্ব বুঝি এইখানেই, এমন একটি বিষয় তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তা পাঠককে মনোযোগ হারাতে দেয় না। অসাধারণ কুশলতায় লেখকের কলমে অঙ্কিত হয়েছে দ্য মেন্ডিক্যান্ট প্রিন্স-এর প্রতিটি দৃশ্য, ছোট ছোট সংলাপে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চরিত্রগুলোতে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, গোপন প্রেমের রটনা, সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, আইনি মারপ্যাঁচ, ঔপনিবেশিক প্রভাবচর্চা, শেষ দৃশ্যে মূল চরিত্রের নাটকীয় মৃত্যু এমন সব উত্তেজনাকর উপাদানে ঠাসা এই উপন্যাসের প্লট, অথচ তা পাঠককে কেবলই লঘুচালে চমক দিয়ে তৃপ্ত করে না; বরং বইটি পাঠান্তে গভীর মানবীয় অনুভবের সূত্রে পাঠক বাঁধা পড়ে যান এর প্রায় প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে। সবটা মিলে ঐতিহাসিক বাস্তবতা আর কল্পনার মিশেলে দ্য মেন্ডিক্যান্ট প্রিন্স হয়ে ওঠে শ্বাসরুদ্ধকর সার্থক ও মানবীয় এক উপন্যাস।