আবুল মোমেন <<
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যায় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। এই সাথে ভারত, পাকিস্তান দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল, মূলত ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু দেশটি স্বাধীন হওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাদের উৎসাহে বড় রকম ধাক্কা লাগে। ধাক্কাটি দিয়েছেন স্বয়ং দেশটির জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। নতুন দেশটির রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি চাইলেন উর্দুকে Ñ যদিও তাঁর মাতৃভাষা উর্দু নয়, গুজরাটি। তাঁর এমনটা ভাবার কারণ ঊনবিংশ শতকে বাংলায় যেমন বাংলাভাষার মাধ্যম শিক্ষাগ্রহণ করা যেত সেভাবেই হায়দ্রাবাদ থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসলমানদের শিক্ষার ভাষা ঘোষণা করা হয়েছিল উর্দুকে। তারই ফলে এসব প্রাদেশিক ভাষার চর্চা রুদ্ধ হয়ে উর্দুর চর্চা বাড়ে মুসলিমসমাজে। তারা মাতৃভাষা কেবল ঘরে ব্যবহার করলেও শিক্ষা, গণমাধ্যম ও অন্যান্য জনকাজে উর্দুভাষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। উর্দুই হয়ে ওঠে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, মারাঠি, গুজরাটি মুসলিমদের শিক্ষা ও সাহিত্যের অর্থাৎ জনপরিসরের ভাষা।
বাংলার অবস্থা তেমন ছিল না। এটি কৃত্রিম ভাষাও ছিল না, চাপিয়ে দেওয়াও নয়। বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটেছিল মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে। কিন্তু এ ভাষায় কাব্যরচনার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল হাজার বছর আগে তাতে মধ্যযুগ থেকেই বাংলার মুসলমানদেরও অংশগ্রহণ ছিল ভালোভাবে। এভাবে বাংলা তাদেরও প্রাণের ভাষা হয়ে ওঠে। আর সৌভাগ্যবশত গদ্য সৃষ্টির সাথে সাথেই বাংলাভাষায় উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অচিরেই মুসলমান লেখকরাও এতে যুক্ত হন। ফলে জিন্নাহ যখন বাংলাভাষাকে অগ্রাহ্য করছেন তখন বাঙালি মুসলমানের এ ভাষায় সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতা বহু শতাব্দী বিস্তৃত Ñ কাব্যে পাঁচ শতাধিক এবং গদ্যে শতাধিক বছর। জিন্নাহ এই ঐতিহ্য, অঙ্গীকার এবং প্রাণের বন্ধন ও ভালোবাসার খবর রাখতেন না। ফলে তিনি যখন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার জনসভা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ভাষণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেবলমাত্র উর্দুর কথা বললেন তখন তাঁর মুখের ওপর জনতা ও ছাত্ররা প্রবল প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। জিন্নাহ ছিলেন জেদি, তাঁর দল ও রাজনীতি চলেছে তাঁরই একক সিদ্ধান্তে, তিনি নিজেকে পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা মনে করেছিলেন। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ও প্রাণের বন্ধন কত তীব্র হতে পারে এ সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। জিন্নাহ এসেছেন ব্যবসায়ী পরিবার থেকে, তাঁর সঙ্গী-সাথীরা সব নবাবজাদা, পীরজাদা, বড় আমলা, ব্যবসায়ী, যাদের ব্যবহারিক জীবন ইংরেজদেরই অনুসরণে তৈরি। তাঁরা সাহিত্যের খবর রাখতেন না, ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়ের মৌলিকত্ব ও গুরুত্ব অনুধাবন করতেন না।
জিন্নাহ করাচি ফিরে গেলেও তাঁর জ্বালিয়ে দেওয়া আগুন থামে নি। প্রথম সুযোগেই গণপরিষদে বাঙালি সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উত্থাপন করেন। তার জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে কঠোর ভাষায় জবাব দিলেন। তাতে অবশ্য বাঙালির ক্ষোভ আরও তীব্র ও বিস্তৃত হল। মূলত আন্দোলনকারী ছাত্রদের উদ্যোগেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হল যাতে আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদেও চালানো সম্ভব হয়। কয়েকমাস নানা দেনদরবার চলল, কিন্তু বোঝা গেল পাক-সরকার যুক্তি মানবে না, তাদের অবস্থান পাল্টাবে না Ñ যদিও এর মধ্যে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর মৃত্যু হয়েছিল। এই পর্যায়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় এবং এ আন্দোলনে প্রথম থেকে যুক্ত তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানও গ্রেপ্তার হন। মাঠ পর্যায়ের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে জেলবন্দি শেখ মুজিবের কাছে তাঁর হাসপাতালের কারাকক্ষে গিয়ে তাঁরা প্রায়ই পরামর্শ নিয়েছেন আন্দোলনে করণীয় সম্পর্কে।
এসব পর্ব পেরিয়ে এলো ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। সে ইতিহাস সবারই জানা। তাতে প্রাণহানি হলেও বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা তো করা গেছেই সঙ্গে মিলেছে বড় প্রাপ্তি Ñ বাঙালির জাতিচেতনার উন্মেষ, অধিকার আদায়ের সংকল্প ও আন্দোলনে উন্মুখ ঐক্য। এসবই ভাষা আন্দোলনের মহৎ অবদান।
এই আন্দোলনের ভাবসম্পদ জুগিয়েছেন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, পথিকৃৎ গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রাবন্ধিক আবদুল হকসহ আরও অনেকেই। এ সময় ছাত্র-জনতা এবং শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনীতিকদের মধ্যে কার্যকর গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসন, বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা করে। এ পর্যায়ে সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, কবি মহিয়সী নারী সুফিয়া কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশার অগ্রসর ব্যক্তিবর্গ এবং দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও অবর্জাভার পত্রিকা সামনে থেকে আন্দোলনের পেছনের যুক্তি ও ভাবনার যোগান দেন। স্বাধীনতা পর্যন্ত একইভাবে এঁরা এবং আরও অসংখ্য লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকর প্রমুখ জাতিকে প্রেরণা ও পথচলার পাথেয় দিয়ে গেছেন। দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও বামভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীরা বরাবর সেই আটচল্লিশ থেকেই সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তির জোগান দিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা। তাঁর সাহসী দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাঙালি শেষ পর্যন্ত জাতি হিসেবে ফলপ্রসূ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সৃষ্টি হল নিজেদের স্বদেশ Ñ বাংলাদেশ।
আজ একটিই কাম্য, যেমনভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুকে মর্যাদার আসন দিয়ে স্মরণ করছি, তেমনি চলার পথের অন্যান্য কুশীলব ও গুণিজনদেরও যেন প্রাপ্য মর্যাদা দেই। সেই সাথে সবচেয়ে বড় কথা হল এই বাংলাদেশ আন্দোলন ও দেশের যে প্রাণভোমরা সেই মাতৃভাষার মর্যাদা, চর্চার প্রতি মনোযোগের ঘাটতি যেন না হয়। বাঙালির জাতিচেতনারই ভিত্তি হল তাঁর হাজার বছরের সংস্কৃতি। কালের উজান বেয়ে ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর এবং স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে দেখি মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ঘাটতি অবশ্যই ঠেকানো যায় নি। দিনে দিনে ঘাটতি বেড়েছে, বেড়ে গেছে শহীদ ও সংগ্রামীদের কাছে ঋণ। এখন মুজিববর্ষে এবং স্বধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সে ঘাটতিপূরণ করতে হবে Ñ আজ সেই অঙ্গীকার গ্রহণেরই দিন। তাহলেই ইতিহাসের দায় পূরণ করা সম্ভব হবে।