তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পারমাণবিক : রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সুপ্রভাত ডেস্ক »
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান গড়িয়েছে ষষ্ঠ দিনে। অভিযানের শুরুর দিকে কেবল সামরিক স্থাপনাসমূহে হামলা চালালেও মঙ্গলবার থেকে কৌশলে কিছু পরিবর্তন এনেছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের সব বড় শহরে হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী।
বুধবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার রাজধানী কিয়েভের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কার্যালয় উড়িয়ে দিয়েছে রুশ বাহিনী। এছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভসহ দেশটির প্রায় সব নগরে বোমাবর্ষণ করছে সেনারা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। অভিযানের শুরু থেকে চতুর্থ দিন পর্যন্ত ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলোই ছিল রুশ বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। নগরাঞ্চল, বেসামরিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতে হামলা করা থেকে বিরত ছিল রুশ সেনারা।
তবে মঙ্গলবার থেকে এই কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দফতর পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলেছেন, সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইউক্রেনের নগরাঞ্চল ও বেসামরিক এলাকাগুলোতেও হামলা হচ্ছে।
তবে কোনো বেসামরিক এলাকায় হামলার আগে সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে রুশ সেনারা মাইকিং করছে বলেও রয়টার্সকে জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষ্যদর্শী।
ইতোমধ্যে রাজধানী কিয়েভের সীমানায় অবস্থান নিয়েছে প্রায় ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সেনাবহর; তবে এখনও রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করেনি।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হয়, ‘রুশ বাহিনী কিয়েভের সীমানায় পৌঁছে গেছে এবং শিগগিরই সেখানকার সামরিক স্থাপনা ও কমিউনিকেশন্স ভবনগুলোতে আঘাত হানা শুরু হবে। রাজধানীবাসীকে অবিলম্বে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।’
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য কয়েক বছর আগে আবেদন করে ইউক্রেন এবং এই ব্যাপারটিকে ঘিরে দ্বন্দ্ব শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে।
এর মধ্যে ন্যাটো ইউক্রেনকে পূর্ণ সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করায় দ্বন্দ্বের তীব্রতা আরও বাড়ে। ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন প্রত্যাহারে ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে গত দুই মাস রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন রেখেছিল মস্কো।
কিন্তু এই কৌশল কোনো আসেনি। উপরন্তু এই দু’মাসের প্রায় প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অভিযোগ করে গেছে যে কোনো সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে রুশ বাহিনী।
খেরসন শহর দখলের দাবি রাশিয়ার
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসন দখলের নেওয়ার দাবি করেছে। বুধবার হামলার সপ্তম দিনে এই দাবি করলো রুশ বাহিনী। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এখবর জানিয়েছে।
রাশিয়ার দাবি সত্য হলে চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর দখল করা বৃহত্তম শহর এটি। প্রায় তিন লাখ মানুষের শহর খেরসন। এটি মিকোলাইভ এবং নিউ কাখোবকা শহরের মধ্যে অবস্থিত।
এর আগে বিবিসি জানিয়েছিল, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে খেরসনের শহরে রুশ সেনাদের অবস্থানের কথা।
শহরটির মেয়র বলেছিলেন, খেরসনের রেল স্টেশন ও বন্দর রুখ বাহিনী দখল করেছে। তিনি জানান, ইউক্রেনীয় সেনা এবং বেসামরিকসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা মানুষের শহর ত্যাগ কিংবা আশ্রয় নেওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে ধ্বংসাত্মক
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, যদি একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হবে। এটি হবে ধ্বংসাত্মক। বুধবার তিনি এই মন্তব্য করেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আরআইএ এই খবর জানিয়েছে।
ল্যাভরভ বলেছেন, ইউক্রেন যদি পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করে ফেলে সেটি হবে রাশিয়ার জন্য সত্যিকার বিপদ।
এর আগে মঙ্গলবারও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে। এটি একটি ‘সত্যিকারের বিপদ’, যার জন্য রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন দেশটির পারমাণবিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
তবে বিশ্লেষকরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, পুতিনের এই পদক্ষেপকে ইউক্রেনে অন্য দেশগুলোকে না জড়ানোর সতর্ক বার্তা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটি হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার ইচ্ছার ইঙ্গিত নয়।
খারকিভে রাশিয়ার ছত্রীসেনাদের আক্রমণ
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের উত্তরপূর্বে রাশিয়ার ছত্রীসেনারা অবতরণ করার পর শহরটির একটি সামরিক হাসপাতালে আক্রমণ চালিয়েছে বলে ইউক্রেইনের সামরিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার থেকে শহরটির ওপর রুশ গোলাবর্ষণ আরও তীব্র হয়ে ওঠার পর এ আক্রমণের খবর এল বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বুধবার ভোরে (স্থানীয় সময়) খারকিভ ও আশপাশের এলাকায় বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠার পরপরই আক্রমণ শুরু হয়। বুধবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিরি জেলেনস্কি খারকিভে রাশিয়ার বোমাবর্ষণকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে খারকিভের কেন্দ্রস্থলে রুশ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়। এই হামলা শহরের কেন্দ্রস্থলে ফ্রিডম স্কয়ারের সরকারি ভবনগুলো লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে নিষিদ্ধ রাশিয়ার উড়োজাহাজ
যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে রাশিয়ার বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগতসহ সব ধরনের উড়োজাহাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রতিবেশী কানাডা ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের আকাশসীমায় রাশিয়ার উড়োজাহাজে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রও একই পদক্ষেপ নিল।
বিবিসি জানিয়েছে, এ নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং এতে দেশটির অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে বলে বাইডেন মন্তব্য করেছেন।
রাশিয়ার লক্ষ্য আমাদের মুছে ফেলা : জেলেনস্কি
ইউক্রেনে আক্রমণের প্রথম ছয় দিনেই রাশিয়ার প্রায় ৬ হাজার সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
যুদ্ধের সপ্তম দিন বুধবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেইন ও এর ইতিহাস মুছে ফেলা।
তবে কেবল বোমা মেরে আর বিমান হামলা চালিয়ে ক্রেমলিন ইউক্রেইনের দখল নিতে পারবে না বলে তিনি মন্তব্য করেছেন, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিয়েভে জার্মান ও তাদের ইউক্রেইনীয় সহযোগীদের হাতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের স্মৃতি সম্বলিত স্থান বাবিন ইয়ারে রাশিয়ার হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জেলেনস্কি বলেন, এই হামলা প্রমাণ করছে, রাশিয়ার অনেকের কাছেই আমাদের কিয়েভ পুরোপুরি বিদেশ।
‘তারা আমাদের কিয়েভ, আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের উপর নির্দেশ আছে আমাদের ইতিহাস, আমাদের দেশ, আমাদের সবাইকে মুছে ফেলার,’ ভিডিওতে এমনটাই বলেছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে এ পর্যন্ত ১৩টি শিশুসহ অন্তত ১৩৬ জন নিহত হয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেবে না চীন
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে ‘একতরফা’ বলে দাবি করেছে চীন। তাই দেশটি পশ্চিমাদের দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেবে না।
চীনের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশনের (সিবিআইআরসি) প্রধান গুও শুকিং বুধবার এ কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি।
ইউক্রেনে সেনা অভিযান পরিচালনার দায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সবশেষ মঙ্গলবার পশ্চিমা মিত্ররা সুইফট গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেম থেকে বেশ কয়েকটি রাশিয়ান ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এছাড়াও রাশিয়ার বিমান সংস্থাগুলোকে ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশটির প্রেসিডেন্ট, তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও রাশিয়ার ৩০০ এমপির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে সহায়তা করার অভিযোগে বেলারুশের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।
এ পরিস্থিতিতে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশনের (সিবিআইআরসি) প্রধান গুও শুকিং বলেন, আমরা এই ধরনের নিষেধাজ্ঞাগুলোতে অংশ নেব না। আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেনের কাজ অব্যাহত রাখব।