ইলু ইলিয়াস :
মনীষাদীপিত বাঙালির এক অনন্যপ্রতিভূ অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ। বাঙালি মনীষার উন্মেষ ঘটে মূলত উনিশ শতকে রামমোহন রায়ের বৌদ্ধিক কর্মপ্রবাহে। অতঃপর অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল-বঙ্কিমবাহিত হয়ে মঙ্গলচেতনার পাশাপাশি বাঙালিমনীষা জন্ম দেয় অনভিপ্রেত শঙ্কা ও বহুধা বিতর্কেরও। সেই সাথে ঔপনিবেশিক দুর্বিপাকে নিক্ষিপ্ত হয়ে আপন পরিচয় ভুলে বাঙালি পরিণত হয় কেবল হিন্দু-মুসলমানে। এরূপ পরিস্থিতিতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আবদুল করিম, উত্তরকালে যিনি অভিহিত হন ‘সাহিত্যবিশারদ’ অভিধায়; সাহিত্যবিশারদ তাঁর উদ্ধারকৃত বাঙালি আত্মসত্তার দালিলিক উপাদানরাজির বৃহৎ অংশই প্রৌঢ় বয়সে দান করে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যা নিয়ে চরম অস্বস্তিতে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান ইতিহাসকার সুকুমার সেন ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সুদীর্ঘ সময় পরিসরে সেসব উপাদানরাজির সনিষ্ঠ ব্যাপক গবেষণার মধ্য দিয়ে আহমদ শরীফ বাঙালি জাতিকে উপহার দেন বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ-পরিচয় ও বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য‘ (১৯৭৮ ও ১৯৮৩), সম্পূরক আলোকধারা ‘বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব’ (২০০১)। বস্তুত এভাবেই মনীষাদীপিত প্রভার ফল্গুধারায় কালের ইতিহাসে সুনিশ্চিত হয়ে যায় অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্থায়িত্ব, অমরত্ব।
আহমদ শরীফের জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচক্রদ-ী গ্রামে। তাঁর পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের করণিক, মাতার নাম সিরাজ খাতুন। ছয়ভাই-বোনের মধ্যে আহমদ শরীফ ছিলেন চতুর্থজন। বেড়ে ওঠেন বাঙালি জাতিসত্তার অনন্যপ্রহরী, প্রখ্যাত প-িত ও পুঁথিসংগ্রাহক-গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অপার স্নেহচ্ছায়ায়।
শৈশবে আহমদ শরীফের লেখাপড়া শুরু হয় চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, পরে পটিয়াস্থ সোবহানিয়া মাদ্রাসায় এবং সেখান থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন পটিয়া রাহাত আলী হাইস্কুলে ক্লাস ফোর-এ। এ স্কুল থেকেই ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে। ১৯৪০ ও ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যথাক্রমে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ পাস করেন। অতঃপর ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থস্থান ও মেধা তালিকায় ষষ্ঠস্থান অধিকার করে বাংলায় এমএ পাস করেন। এবং ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘সৈয়দ সুলতান : তাঁর যুগ ও গ্রন্থাবলী’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য, যে-অভিসন্দর্ভের কোনো গবেষণা নির্দেশক ছিল না- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন পিএইচডি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রদান করে সম্মানসূচক ডিলিট।
আহমদ শরীফের কর্মজীবনের সূচনা হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে লাকসামের পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলা বিষয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে। সেখান থেকে ১৯৪৮-এর ডিসেম্বর মাসে যোগ দেন ফেনী ডিগ্রি কলেজে; ১৯৪৯-এর জুনে ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর ঢাকা কেন্দ্রে ‘প্রোগ্রাম অ্যাসিসট্যান্ট’, তাঁর ভাষায় ‘কর্মসূচি নিয়ামক’ পদে। কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ে সেখানে তাঁর অবস্থান হয়ে পড়ে বেশ দুর্বিষহ। সেখান থেকে মুক্তি চান তিনি- কিন্তু কর্মহীন, উপার্জনবিহীন জীবনও তখন অসম্ভব। কারণ ইতোমধ্যে সংসারী হন তিনি। ১৯৪৭-এর ৭ নভেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফেনীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি খানসাহেব শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ মাহমুদের কন্যা সালেহা মাহমুদের সাথে এবং ১৯৫০-এর ১৮ মার্চ তাঁদের বিবাহিত জীবনকে বিভান্বিত করে ভূমিষ্ঠ হয় প্রথম সন্তান মাহমুদ করিম।
এদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জন্যে রেজিস্টারের মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে তাঁর সংগৃহীত পুঁথিসমূহ পর্যাপ্ত অর্থমূল্যে প্রাপ্তির আবেদন জানান। সাহিত্যবিশারদের বয়স তখন ৮২ বছর। জীবনের অন্তিম লগ্নে সারাজীবনের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের এই সঞ্চয় পুঁথিসমূহকে কোনোরূপ আর্থিক মূল্যে তুলিত করে সেই ত্যাগের দীপ্তিকে এতটুকুও ধূসর করতে চাননি তিনি; তাই সিদ্ধান্ত নেন পুঁথিসমূহ দান করে দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
তখন ‘রেডিও পাকিস্তানে’ কাজ করার দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের আশায় পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে আহমদ শরীফ বলেন তাঁর এই পুঁথিদানের সাথে তিনি যেন একটা শর্ত জুড়ে দেন। আর তা হলো তাঁকে অর্থাৎ আহমদ শরীফকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিতে হবে। এবং এ প্রসঙ্গে সাহিত্যবিশারদ যে যুক্তি উপস্থাপন করেন, তাহলো, তাঁর ভাষায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পুঁথিপড়ুয়া’ কোনো লোক নাই। কাজেই তাঁরা যদি আহমদ শরীফকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙলা বিভাগে শিক্ষক করে নেন, তাহলে পুঁথিপড়ার এবং চর্চার একজন লোক মিলবে।’ পুত্রতুল্য আহমদ শরীফের যৌক্তিক আবদার গ্রাহ্য করলেন সাহিত্যবিশারদ। শর্ত মেনে নিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষও, কিন্তু কোনো পদশূন্য না থাকার কারণে আহমদ শরীফের নিযুক্তি ঘটে ‘রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে। অর্থাৎ সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পাঁচ শ সাতানব্বইটি পুঁথির সাথে ১৯৫০ খিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আহমদ শরীফ। সেদিন কি কেউ এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর সংগৃহীত অমূল্য পুঁথিসমূহের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন আরও একটি অমূল্যরতœ, একজন আহমদ শরীফকেও!
গবেষণা সহকারী হিসেবে প্রবেশ করে গবেষণারই অত্যুজ্জ্বল দীপালোকে শেষ অবধি তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অহংদীপ্ত অবিস্মরণীয় শিক্ষক। গবেষণা সাহিত্যের আরেক ধ্রুবতারা তাঁর ছাত্র হুমায়ুন আজাদ শিক্ষক আহমদ শরীফ সম্পর্কে বলেন, ‘চেয়ারে বসে তিনি নাম ডাকেন, তারপর এদিক-ওদিক পায়চারি করতে-করতে কলাভবনকে থরথর করে কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেন। পাঠ্যপুস্তক পেরিয়ে যান মুহূর্তে। আবার যখন ফিরে আসেন দৌলত উজির বাহরাম খান বা আলাওল, বড়– চ-ীদাসের কালে, তখন আমরা সভ্যতা ও ইতিহাসের বড়ো বড়ো যুগ তাঁর সাথে যাপন করে এসেছি। এর মাঝে তিরস্কৃত হয়েছেন অনেক প্রাতঃস্মরণীয়, বাতিল হয়ে গেছেন বহু মহাপুরুষ, বন্যায় ভেসে গেছে অনেক সংস্কার, ভাঙা কুঁড়েঘরের মতো নড়োবড়ো হয়ে পড়েছে বহু ভারী বিশ্বাস। কথা বলেন অনর্গল স্রোতে, মাঝেমাঝে বিশেষ-বিশেষ শব্দের ওপর ভারী জোর দিয়ে ও টেনে। বুঝে ফেলেছিলাম অধ্যাপক আহমদ শরীফ কোনো সবাক পাঠ্যপুস্তক নন। যা পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে দুচারখানা বইয়ে তা অবিকল ধ্বনিত করার জন্যে। তাঁর মাঝে আমরা দেখেছিলাম বহুজ্ঞানে জ্ঞানী প-িতকে। চিত্তবিনোদনের কোনো লক্ষ্য ছিল না তাঁর। বরং জ্ঞানার্থীর চেতনা ধরে ঝাঁকুনি দেয়াই তাঁর অভ্যাস। তাঁর ক্লাসে অবস্থানের অভিজ্ঞতা তীব্র উত্তেজনা, উল্লাস, দ্বন্দ্বের মধ্যে অস্তিত্বশীল থাকারই অভিজ্ঞতা।’
হুমায়ুন আজাদের এই ভাষ্যের অনুরূপ প্রতিধ্বনি অন্যরূপে, অন্যভাবে পাওয়া যায় অধ্যাপক আহমদ কবির, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ, অধ্যাপক সেলিম আল দীন, এমনকি আহমদ শরীফের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের প্রথম পর্যায়ের ছাত্র এদেশের সর্বমান্য জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের রচনাভাষ্যেও। প্রকৃতপক্ষে আহমদ শরীফ ছিলেন ডিরোজিও ঘরানার শিক্ষক, যিনি সর্বপ্রকার সংস্কার-বিশ্বাসমুক্ত সজীব-সবাক-সচল সমাজবিনির্মাণে বহুতর বিষয়ে জ্ঞান-অন্বেষণে শিক্ষার্থীদের বহুমুখি জিজ্ঞাসা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ ও উত্তেজিত করে অবিরল গতিমান রাখেন মুক্তচিন্তার ঝরনাপ্রবাহে। এবং উত্তরকালে ড. আহমদ শরীফকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে জ্ঞানচর্চার একটি বিশিষ্ট ঘরানাও। আহমদ শরীফ ছিলেন গবেষকদের গবেষক এবং এ বিষয়ে তাঁর উচ্চতা এমনই ছিল যে, তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কোনো নির্দেশক ছিল না, ছিল না পরীক্ষক ও কোনও পরীক্ষাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে ডিগ্রি প্রদান করে গৌরবান্বিতই হয়েছে।
আহমদ শরীফের মৌলিক গ্রন্থসংখ্যা পঁয়তাল্লিশটি, সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা সাতচল্লিশটি। তাঁর মৌলিক রচনারাজির উপজীব্য বহুমুখি। সাহিত্য, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমকালীন জনজীবনের সংস্কার-বিশ্বাসসহ নানা প্রসঙ্গ। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে প্রধান হয়ে ওঠে ইহজাগতিক এষণা ও ইতিহাসবোধ। আর এই ইহজাগতিক এষণায় উদ্ভাসিত হয় অসাধারণ মানব-মহত্ব। ইতিহাসবোধে সঞ্চারিত হয় বাঙালিত্বের অপূর্ব ব্যঞ্জনা। ফলে তাঁর রচনাবলি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির অমূল্যসম্পদ। স্মর্তব্য যে, আজীবন অসাধারণ সব জ্ঞান উজাড় করে দিয়ে জাগতিক অন্তিম মুহূর্তে মরদেহটিও দান করে দিলেন তিনি দেশের শিক্ষার্থী-গবেষকের জ্ঞানচর্চায়।
বাঙালি জাতির এই অবিস্মরনীয় সন্তান, শিক্ষক-গবেষক প্রাজ্ঞপ-িত অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জ্ঞাপন করি অন্তর উৎসারী প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, প্রদীপ্ত ভালোবাসা।