মোহাম্মদ নাজিম, হাটহাজারী
যাদের জন্ম থেকে হাত নেই। দুর্ঘটনায়যারা হাত হারিয়েছেন বা হাতের কব্জি হারিয়েছেন তাদের জন্য নতুন আশা দেখাচ্ছেজয়ের তৈরি রোবটিক কৃত্রিম হাত।
জয় বড়ুয়া লাভলু (১৮)হাটহাজারী উপজেলার ১১ নম্বর ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী রবি বড়ুয়ার সন্তান। লাভলু তৈরি করেছেন রোবটিক কৃত্রিম হাত। বর্তমানে লাভলু চট্টগ্রামের একটি কলেজে ইলেকট্রনিক ও মেকানিকের উপর ডিপ্লোমা করছেন।তারা এখানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তাদের নিজ বাড়ি উপজেলার কাটিরহাট এলাকায়।
গতকাল বুধবার দুপুরে জয় বড়ুয়া লাভলুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, চার রুমের একটি ঘরের তিনটিতে থাকেন এবং একটিতে ল্যাব তৈরি করেন। এই ছোট ল্যাবে তৈরি হয় কৃত্রিম হাত।
যাদের হাত নেই, তাদের জন্য হাত কেন তৈরি করে দিতে পারবে না? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলেন জয় বড়ুয়া লাভলু। উত্তর খুঁজতে গিয়ে ছোট থেকে চর্চা করা নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করে ফেললেন একাধিক কৃত্রিম হাত। তার তৈরি সেসব হাত সাড়া দেয় মানুষের স্নায়বিক আবেদনে। শরীরের বিভিন্ন নার্ভের সাথে সংযুক্ত করে দিলে কৃত্রিম হাতগুলো কাজ করে অনেকটা স্বাভাবিক হাতের মতোই। পানি খাওয়া, কলম দিয়ে লিখা, বই উল্টানো, খাবার খাওয়ার মত হালকা কাজগুলো করা যায় খুব সহজে।
রোবটের তৈরি কৃত্রিম হাতের উদ্ভাবক জয় বড়ুয়া লাভলু বলেন, লেখাপড়ার শুরু থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০১৭ সাল থেকেই কৃত্রিম হাত তৈরি করতে শুরু করি। শুরুতে বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনতাম। অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায় না, চড়া দামে বিদেশ থেকে এগুলো আনতে হতো।
কৃত্রিম হাতের ৪টা প্রজেক্ট আছে আমার। এর মধ্যে প্রথমটা হলো যাদের হাত গোড়ালির উপর থেকে কাটা, তাদের জন্য কৃত্রিম হাত। এটা হাতের কাটা অংশে স্থাপন করতে হয় মূলত। তবে এর জন্য কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন নেই, কৃত্রিম হাতের সেন্সরগুলো কাটা হাতের নার্ভ বরাবর সংযুক্ত করে দিলেই হয়। এতে স্নায়বিক আবেদনে সাড়ে দেবে কৃত্রিম হাতটি। ইতোমধ্যে হাত কাটা একটা লোকের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখেছি এটা।
কৃত্রিম হাতের দ্বিতীয় প্রজেক্টটি হলো যাদের কনুইয়ের উপর থেকে হাত কাটা তাদের জন্য। এটাও প্রথমটার মত সেট কটতে হয়। কাজও করে সেভাবে।
তৃতীয়টি হলো থার্ড হ্যান্ড। এটা কৃত্রিম হাত হলেও স্বাভাবিক মানুষদের জন্য। এটা মূলত বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে বেঁধে সেট করতে হয়। তবে এই হাতের নিয়ন্ত্রণ থাকে পায়ে। মানুষের অন্য দুই হাতের পাশাপাশি এই হাত দিয়েও সারানো যাবে স্বাভাবিক কাজকর্ম। এই প্রজেক্টটি ২০১৮ সালে ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত আইডিইবির ইনোভেশন ল্যাবে (ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশ) একটি রোবট প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো।
অন্যটি হলো ওয়ারল্যাস হ্যান্ড। মানুষের স্বাভাবিক হাতকে দূর থেকে অনুকরণ করতে পারে এই হাত। এই হাত দিয়ে মূলত দূর থেকে বোমা নিষ্ক্রিয় করার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করা যাবে।’
লাভলু আরও বলেন, ছোটবেলায় বাবাকে ঘরে অকেজো হয়ে যাওয়া বিভিন্ন যান্ত্রিক জিনিস মেরামত করতে দেখতেন। বাবাকে দেখেই যন্ত্রের প্রতি আগ্রহ জাগে। সেই আগ্রহ থেকে ছোটখাটো বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন ছোট থেকেই।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি রোবট বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন স্কুলের সবাইকে।
ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ে রোবটিক্সে। আর রোবটিক্সের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় নিজ উপজেলার বিজ্ঞান মেলায় কর্মক্ষম রোবট তৈরি করে সবার সেরা হন। পরের বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় মাছ চাষে সাহায্যকারী একটি রোবট তৈরি হন প্রথম রানার আপ।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে পরিবারের সমর্থন পেয়েছি ঠিক। তবে বাবা মা কিছুটা উদ্বিগ্ন থাকেন। বিদ্যুতায়িত হয়ে কারো মারা যাওয়ার কথা শুনলেই এসব ইলেক্ট্রিকেল সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে বলতেন। আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে শুরুতে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা বিদ্রুপ করতেন। এসব দিয়ে কী হবে, শুধু টাকা খরছ কেন করছি-এসব কথা বলতেন সবাই। কিন্তু এখন সবাইঅনুপ্রেরণা দেয়, কারণ তারা টিভিতে দেখছে, আমার কাজগুলো সামনে দেখছে।’
দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট লাভলু। বাবা ফার্নিচার ব্যবসায়ী। লাভলু মাধ্যমিক শেষ করেছেন স্থানীয় জোবরা পি পি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। বর্তমানে নগরীর একটি কলেজে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা পড়ছেন তিনি। ডিপ্লোমা শেষ করে লাভলুর ইচ্ছে ঢাকা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢুয়েট) রোবটিক্স সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করার।
লাভলুর বাবা রবি বড়ুয়া বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। অনেক কষ্টে আমরা দুই ছেলেকে পড়াশোনা শিখাচ্ছি। ছেলে যেন মানুষের মত মানুষ হয়, তার স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। তাই সকলের সহযোগিতা চাই।
এ বিষয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম বলেন, হাটহাজারীর ফতেপুর এলাকার ছেলে জয় বড়ুয়া লাভলু কৃত্রিম হাত তৈরি করেছেন। যেটি রোবটের সাহায্য তৈরি করা।মূলত যাদের হাত অথবা হাতের কব্জি নেই তাদের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা করছি। লাভলুকে যে কোন ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।