সুপ্রভাত প্রতিবেদন »
২০২১ সাল, বাংলাদেশ এই বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলো। একটি জাতির ইতিহাসে এটা অনেক বড় একটি গর্বের বিষয়। আর এই বছরেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয়ে ভারত পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। করোনার ধকল কাটিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তৈরি পোশাক খাত সামলে উঠেছে। রেমিটেন্স-এর ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে।
বছর শেষের আলোচিত ঘটনা কক্সবাজারে পর্যটন এলাকায় নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আর লঞ্চে আগুন লেগে যাত্রীদের মুত্যু, বেদনায় ভারাক্রান্ত করেছে দেশের মানুষকে।
রাজনীতিতে শিষ্টাচারে অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে এই ২০২১ সালে। অশিষ্ট কথা-আচরণের জন্য মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে। অন্যদিকে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার পর ক্ষমা চেয়েছেন।
কুয়েতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের কারাদ- হয় মানবপাচার, প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে। বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো অর্থ পাচার। আর এই অর্থ পাচারে কানাডায় পলাতক পিকে হালদারের নাম এসেছে সবার আগে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আর চিকিৎসার বিষয় নিয়ে সারা বছরই সরব থেকেছে বিএনপি। কিন্তু কোনো ফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি। নতুন বছরে তারা নতুন আন্দোলনের কথা বলছে।
আর শাসক দল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীদের নানা ধরনের বিতর্কিত কাজে বিব্রত ছিলো। বেফাঁস কথার জন্য তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে বিদায় করা ছাড়াও গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও আরো দুই পৌর মেয়রকে বিদায় করতে হয়।
ইউপি নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে নাই। তারপরও নির্বাচনে সন্ত্রাস সহিংসতা বড় বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হওয়ার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
ডিজেল আর কেরোসিনের দাম বাড়ায় বাস ভাড়ার ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরিবহন মালিকেরা জিম্মি করেই বাস ভাড়া বাড়িয়ে নেয়। আর তারই বিপরীতে ছাত্ররা মাঠে নামে হাফ ভাড়ার দাবিতে। ঢাকার সড়কে সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় কলেজ ছাত্রের মৃত্যু হয়। ফলে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনও করেন ছাত্ররা। হাফ ভাড়ার দাবি পূরণ হলেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমেনি।
ডিজেলের দাম বাড়ায় তার প্রভাব পড়েছে সবখানে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়।
বছরে প্রথম দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমেছিলো হোফাজতে ইসলাম। তারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় নাশকতাও করে। তার জেরে ব্যাপক চাপে পড়ে হেফাজত। মামুনুল হকসহ হেফাজতের অনেক শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায়ও মাঠে নেমেছিলো।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকা- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত হয়। জানা যায় আরসার উপস্থিতি। আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা।
এবার পূজার সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের ৩৪টি জেলায় পূজাম-প ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে কোরান অবমননার গুজব ছড়িয়ে এই হামলা শুরু হয়।
এবারো আগুনে বস্তি পুড়েছে। পুড়েছে কারখানা। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে একটি কারখানায় আগুনে ৫৫ জন নিহত হয়েছেন। লঞ্চে আগুনের ঘটনা ছাড়াও লঞ্চডুবিতেও মানুষ মারা গেছে।
চিত্রনায়িকা পরীমনি ছিলেন আলোচনায়। তাকে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আরো কয়েকজন মডেল গ্রেপ্তার হয়েছেন মাদকের অভিযোগে।
এই বছরেই বহুল আলোচিত ব্লগার অভিজিৎ, প্রকাশক দীপন এবং বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায় হয়। যা আশার আলো জাগিয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ঋণ আত্মসাত ও পাচারের মামলার রায়ে মোট ১১ বছর কারাদ- হয়েছে। তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কারাদ- এটাই প্রথম। করোনার রাহুকাল কাটিয়ে এই বছরেই আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। শুরু করা গেছে পরীক্ষা।
ক্রীড়া অঙ্গনের সবচেয়ে বড় সুখবর হলো বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা টেস্ট মর্যাদাও পেয়েছে। পুরুষদের ক্রিকেটে খারাপ সময় গেছে বাংলাদেশের।
এই বছরে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরু হয়েছে। চলবে নতুন বছরেও। বিএনপি এই সংলাপ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন আর গণতন্ত্র নিয়ে এই দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও বৈষম্য বাড়ছে। দারিদ্র্য বেড়েছে। বেড়েছে আয় বৈষম্য। তবে পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রকল্পের কাজ করোনার মধ্যেই এগিয়েছে।
এই বছরেই বাংলাদেশে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়। শুরু হয়েছে বুস্টার ডোজও। তবে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি কমানো গেছে বলা যাবে না।
সবসময়ই অন্ধকার সুরঙ্গের শেষে আলোর দেখা মেলে। ২০২১ সম্পর্কে এ কথাটা যেন খুবই বেশি করে সত্যি। বছরটা শুরু হয়েছিল করোনা-আতঙ্ক দিয়ে। চারপাশে শুধু আতঙ্ক, হতাশা, মৃত্যুর ছবি। মনে হচ্ছিল, এই অন্ধকার সময় যেন আর কাটবে না। লকডাউন, ঘরবন্দি মানুষ, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ মনকে বিবশ করে দিতো। কিন্তু ওই যে খারাপের শেষে ভালোর ঝলক থাকে। দুঃখ, মৃত্যুর পরও থেকে যায় আশা, থেকে যায় প্রাণের নিত্যধারা, তাই সব শেষ হয় না, হতে পারে না।