আলোর মুখ দেখছে রেল কর্ড লাইন

ঢাকা-চট্টগ্রাম দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। সময় বাঁচবে ৯০ মিনিট।

ডেস্ক রিপোর্ট »

সড়কপথে চট্টগ্রাম-ঢাকার দূরত্ব ২৪৮ কিলোমিটার। রেলপথে এ দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে হয় টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়া ঘুরে। সড়কের চেয়ে রেলে বেশি সময় ব্যয় করে ঢাকায় যেতে হয়। এই বাড়তি দূরত্ব ও সময় কমিয়ে আনতে একমাত্র সমাধান ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন।

গতিপথ সোজা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ আগেই নেয়া ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রথমে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে লাকসাম, পরে কুমিল্লা পর্যন্ত একটি কর্ড লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। এটি বাস্তবায়ন হলে ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমে আসবে।

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, এই লাইন চালুর পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেলপথের দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার কমে যাবে। একইসঙ্গে সময় কম লাগবে প্রায় ৯০ মিনিট।

নির্মাণের পর এই লাইনটি শুধু যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হতে পারে। বর্তমানে চালু থাকা ৩২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনটি সেক্ষেত্রে মালামাল পরিবহনে ব্যবহার হতে পারে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘রেলওয়ে কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-লাকসামের মধ্যে কর্ডলাইন নির্মাণের জন্য সমীক্ষার কাজ শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সমীক্ষার কাজে জাপান, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়ার তিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়ামকে নিযুক্ত করা হয়। যদিও চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয় তৎকালীন সরকার।

বন্ধ হয়ে যাওয়া সমীক্ষার কাজ পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ২৫ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রকল্পটির সমীক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ঢাকা-কুমিল্লা/লাকসাম কর্ডলাইনের জন্য চারটি বিকল্প রুট তুলে ধরেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। এতে ‘অপশন ১এ’ ছাড়াও ‘অপশন ১বি’, ‘অপশন ২’ ও ‘অপশন ৩’ উপস্থাপন করা হয়। অপশন ১এ ও অপশন ১বি’র মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত ‘অপশন ২’-এর গতিপথ নির্ধারণ করা হয় শ্যামপুর-নারায়ণগঞ্জ-বন্দর-সোনারগাঁ-মেঘনা-তিতাস-দাউদকান্দি-মুরাদনগর-চান্দিনা-বরুড়া-কুমিল্লা সদর পর্যন্ত। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৮২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে ‘অপশন ৩’-এর গতিপথ নির্ধারণ করা হয় শ্যামপুর-নারায়ণগঞ্জ-বন্দর-সোনারগাঁ-মেঘনা-তিতাস-দাউদকান্দি-চান্দিনা-বরুড়া-কুমিল্লা সদর পর্যন্ত। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৮৯ কিলোমিটার।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেলপথে যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। কর্ডলাইন নতুন রেলপথটি নির্মিত হলে ভ্রমণ সময় দেড় ঘণ্টা কমে আসবে। সব মিলিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব কমবে প্রায় ৯০ কিলোমিটার।

অন্যদিকে টঙ্গী-ভৈরব-আখাউড়ার মধ্যকার বিদ্যমান লাইনটিও সচল থাকবে। দুই লাইনে গতিশীল হবে রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেসের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। কর্ডলাইন বাস্তবায়ন হলে ট্রেনটির যাতায়াত সময় ৩ ঘণ্টা ৫ মিনিটে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

কর্ডলাইন বাস্তবায়নের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া শ্যামপুর-নারায়ণগঞ্জ-বন্দর-সোনারগাঁ-মেঘনা-তিতাস-মুরাদনগর-দেবিদ্বার-বুড়িচং-কুমিল্লা সদর রুটে সাতটি স্টেশনের প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। এর মধ্যে শ্যামপুর ও কুমিল্লায় স্টেশন রয়েছে। পাঁচটি স্টেশন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। স্টেশনগুলো হলো জালকুঁড়ি, সোনারগাঁ, তিতাস, দেবিদ্বার ও বুড়িচং।

এর আগে রেলওয়ের করা এক প্রাক-সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, রুটের ২০ দশমিক ৭ কিলোমিটার অংশ তৈরি করা হবে উড়ালপথে। বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এর বাইরে তৈরি করতে হবে ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মেঘনা সেতু। শিল্প এলাকার উত্তর দিকে সেতুটি তৈরি করতে হবে। রেলপথের জন্য বাঁধ তৈরি করতে হবে ৫৫ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ‘অপশন-১এ’-এর জন্য প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৬১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। যদিও রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটা প্রাথমিক ও আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় কত হবে, তা সমীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।

কর্ড লাইন নির্মাণের আলোচনা কয়েক দশক ধরে চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১০ সালে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল।

এমনকি, ২০১২ সালে রেল মন্ত্রণালয় একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় এই লাইন নির্মাণের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। তবে অজ্ঞাত কারণে এই উদ্যোগে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বলে জানান রেল কর্মকর্তারা।

এডিবি এই প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখানোয় ২০২০ সালের জুনে সরকার এই ২৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব কমাতে কর্ডলাইন রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। প্রকল্পটির সমীক্ষা শুরুর পর স্থগিত করে দেয়া হয়। এখন সমীক্ষার কাজ আবার শুরু করা হবে।