প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রত্যাবাসনে রায় দিয়েছে ১৩২ দেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক :
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমরা প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছি। একইভাবে রোহিঙ্গা সমস্যাও সমাধান হতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে বিশ্বের ১৩২টি দেশ রায় দিয়েছে। মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে কথা দিয়েছিল।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম এর দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। প্রধান আলোচক ছিলেন চবি আইন অনুষদের প্রফেসর এ বি এম আবু নোমান।
এ কে আবদুল মোমেন বলেন, আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ সবদেশে গেছি। সবাই স্বীকার করেছে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। তাই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে তাদের। সবাই বলেছে, স্থায়ী সমাধান হলো লোকগুলো ফিরিয়ে নেওয়া। তাই সেইদিন থেকে এখনও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি চালকের আসনে রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা বারবার বলছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে ভেরিফিকেশন করার পর। তারা কখনও বলেনি, রোহিঙ্গাদের নেবে না। আমরা বলেছি, তাদের নিয়ে যেতে তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তারা অঙ্গীকার করেছে নিয়ে যাবে। কিন্তু এরপরও আজ প্রায় সাড়ে ৩ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। কারণ তাদের মধ্যে রয়েছে আন্তরিকতার অভাব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত বছরের ২০ জানুয়ারি মিয়ানমারের সঙ্গে বড় মিটিং হয়। এরপর কোভিড ও নির্বাচনের বাহানা দিয়ে তারা আর মিটিং করেনি। আমরা আশা করছি, নতুন করে তাদের সঙ্গে বসবো। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে দেখেছি, তখন অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল, তারা আবার নিয়েও গেছে। ১৯৯২ সালে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার রোহিঙ্গা দেশে আসে। পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে তারা ২ লাখ ৩০ হাজার নিয়ে যায়।
রোহিঙ্গা না যাওয়ার কারণ তারা মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করে না উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই রোহিঙ্গারা যায় না কেন? দুইবার চেষ্টার পরও যায়নি। একটি বড় কারণ রোহিঙ্গারা তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আমরা তাদের তিন ধরনের প্রস্তাব দিয়েছি। একটি বলেছি, মিয়ানমার সরকারের নেতারা এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলুক। তারা একবার এসেছিল, পরে প্রশ্নের মুখে পড়ে আর আসেননি। আমরা তাদের বলেছি, রোহিঙ্গা মাঝিদের নিয়ে পরিদর্শন করাতে। তারা এর কোনো উত্তর দেয়নি। সরকারকে যেহেতু রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে না, তাই তাদের নন মিলিটারিস সিভিলিয়ানকে রাখাইনে রাখার জন্য বলেছি। তাতে, বলা যেত সেখানে তৃতীয় পক্ষ আছে, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে কোনো অসুবিধা হবে না। তারা সেটিও মানেনি। হ্যাঁ বা না কোনোটি বলেনি।
কৌশলগত কারণে প্রতিবেশী দেশ আমাদের পক্ষে থাকেনি উল্লেখ করে আবদুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আন্তর্জাতিক ফোরামেও নিয়ে গেছি। ১৩২টি দেশ আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো।
প্রকাশনা অনুষ্ঠান সম্পর্কে তিনি বলেন, এমদাদুল ইসলামের ‘রোহিঙ্গা নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ বইটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের ওপরে এ রকম তথ্য ও রেফারেন্সভিত্তিক বইয়ের খুবই অভাব। এ বইটিতে রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্যে দীর্ঘদিন বসবাসের ইতিহাস লেখক বিভিন্ন রেফারেন্সের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। বইটি ইংরেজিতে প্রকাশ করার জন্য তিনি লেখককে অনুরোধ জানান, যাতে বিশ্ববাসী রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক ও রেফারেন্সসহ বিস্তারিত জানতে পারে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, বর্তমানে আমাদের যে প্রবণতা আমরা শুধু তথ্য ধারণ ও সংগ্রহ করি কিন্তু জ্ঞান চর্চা ও অর্জন এবং সেটা অনুধাবন করা থেকে অনেক দূরে। তার কারণ আমরা কেবল তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। কিন্তু তথ্য ও জ্ঞানের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া মানেই জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়া নয়। তথ্যকে ধারণ করে বিশ্লেষণ করে সেটা নিয়ে আমাদের উপলব্ধিই হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ যে জনমুখি, জনগণের এবং মানবতার রাজনীতি করে সেটা প্রমাণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রোহিঙ্গাদের সেবায় খাদ্য, ওষুধ ও বস্ত্র বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর এ মানবিক চরিত্র বা দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম কারণ তাঁর সার্বক্ষণিক জ্ঞানচর্চা। সমাজ-রাষ্ট্র, কৃষ্টি রীতিনীতি প্রত্যেকটা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং সেটাকে ধারণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে বলেই তিনি বিশ্বের রাজনীতিকদের মধ্যে অন্যতম দৃষ্টান্ত।
প্রধান আলোচক অধ্যাপক এ বিএম আবু নোমান বইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। বইটিতে লেখক রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বইটির প্রথম অধ্যায়ে লেখক বিভিন্ন রেফারেন্সের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার ভূখণ্ডের অধিবাসী। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর উপরে মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার নিপীড়নের আলোচনা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহের ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার আলোচনা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সুপ্রভাত বাংলাদেশ এর সম্পাদক রুশো মাহমুদ বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে দুই থেকে তিন বছর আগেও আমরা সেভাবে জানতাম না। যতটাই আমরা ভারত সম্পর্কে জানি ততটাই কম জানি মিয়ানমার সম্পর্কে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের নিপীড়িত ও নিগৃহীত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। এই জনগোষ্ঠীর দুদর্শা আর তাদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কাছ থেকেই দেখেছেন মেজর এমদাদ। তাঁর বর্ণনায়, তাঁর লেখনিতে তা উঠে এসেছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঐতিহাসিক পরম্পরা এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের কথা তিনি তাঁর ‘রোহিঙ্গা নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ বইটিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। যাদের দক্ষিণ এশিয়ার ও এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহ আছে সর্বোপরি যারা মিয়ানমার নিয়ে চর্চা করতে চান তাদের অধ্যয়ন ও অনুশীলনে বইটি অত্যন্ত সহায়ক ও প্রয়োজনীয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ কোরিয়ার অনারারি কনসাল ও পিএইচপি ফ্যামেলির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন।