রাজিব শর্মা »
চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের পর এবার আলু নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর আলুর উৎপাদন ও যোগান ভালো থাকার পরও নিয়ন্ত্রণে নেই এ বাজার। অতি মুনাফার লোভে অবৈধ মজুদ করে আলুর দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল শনিবার সকালে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের আলুর আড়তে দেখা যায়, থরে থরে সাজানো রয়েছে আলুর বস্তা। রয়েছে পর্যাপ্ত মজুদও। পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন আলুর দাম বাড়ছে তার যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। খুচরা দোকানিরা দুষছেন পাইকারদের আর পাইকাররা দুষছেন আড়তদার ও মধ্যস্বত্ব কারবারিদের।
এদিকে, শনিবার পাইকারি বাজারে মুন্সীগঞ্জের আলু বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। একই মানের আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা। আর কুমিল্লার আলু ৬৫ টাকা, নঁওগার আলু ৭৫ টাকা এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার দেশি আলু বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, গতবছর এদিনে আলু বিক্রি হয়েছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। তা দাম বেড়ে গত মাসে বিক্রি হয় ৩৬ টাকা। আর চলতি মাস (সেপ্টেম্বরে) আরো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৬০ টাকা।
কৃষি বিপণন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭০০ টন। এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ১০ টাকা। যা তারা বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ১৮ টাকা। এই ১৮ টাকায় আলু কিনে যারা কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন, প্রতি কেজিতে তাদের খরচ হয়েছে ৫ টাকা। এতে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়েছে ২৩ টাকা। চট্টগ্রামের বাজারে আসা পর্যন্ত খরচসহ হিসেবে করে প্রতি কেজি আলুর দাম হওয়ার কথা সাড়ে ২৪ টাকার চেয়ে একটু বেশি।
ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চাহিদা অনুযায়ী দেশের উৎপাদিত আলুর সাড়ে ৫ শতাংশ স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি হয়। বাকি ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ জেলা পর্যায়ে বা সারা দেশে বিক্রি হয়ে থাকে।
আলু উৎপাদন হয় এমন ১০টি জেলার পাওয়া তথ্যমতে. কৃষক তার মোট উৎপাদনের ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ স্থানীয় বড় ব্যাপারির কাছে বিক্রি করে। বাকি ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ ফড়িয়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান। মাত্র ১ শতাংশ স্থানীয় বিক্রেতার মাধ্যমে বিক্রি হয়।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আলু ব্যবসায়ের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত থাকা উৎপাদক থেকে শুরু করে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা গড়ে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা কেজি করে আলু বিক্রি করেন। আর তাদের মুনাফার পরিমাণ সাড়ে তিন টাকা। এরপর কৃষক ৩ টাকা ৬২ পয়সা এবং পাইকাররা ১ টাকা ১৪ পয়সা মুনাফা করেন। আর ফড়িয়ারা প্রতি কেজিতে এক টাকার মতো মুনাফা করেন। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আলুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন ফড়িয়ারা।
ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা
খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে আড়তদাররা ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি আলু কিনেছেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। সেই হিসেবে কেজিপ্রতি আলুর দাম পড়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকায়। কিন্তু সেসব আলু কিনতে হচ্ছে বস্তাপ্রতি ১ হাজার ৯০০ থেকে ১ হাজার ৯৫০ টাকা।
ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমান খাতুনগঞ্জের বাজারে যারা আলু মজুদ করেন বা কোল্ড স্টোরেজ থেকে সংগ্রহ করেন তার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীসহ মোট ৭ জন ব্যবসায়ী আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আলু ব্যবসায়ী বলেন, খাতুনগঞ্জের আলু ব্যবসার কারবার করেন ৭ জন ব্যবসায়ী। হিসাব মতে, কোল্ড স্টোরেজ থেকে আনাসহ কেজিপ্রতি আলুতে খরচ পড়ে ২৫ থেকে ২৬ টাকা। সামান্য কিছু টাকা লাভে তারা সেই আলু বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু সেই আলু তারা পাইকারি বাজারে ৩৮ থেকে ৪১ টাকা দাম হাঁকছেন। তাদের কাছে জিম্মি ছোটখাটো আলু ব্যবসায়ীরা। এমনকি বৃহস্পতিবার সরকার দর নির্ধারণ করে দিলেও ওই দামে পাইকারি ব্যবসায়ীদেও কাছে বিক্রি করছে না এসব ব্যবসায়ী। ফলে কম দামে আলু বিক্রি করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। মধ্যস্বত্ব কারবারিদের এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রশাসনের জোরালো পদক্ষেপ আশা করেন খোদ খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ীরা।
খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দামে আলু বিক্রি
পাইকারি বাজারে যে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৩৮ টাকা তা খুচরা পর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। কেন দ্বিগুণ নেওয়া হচ্ছে এর যথাযথ কোন উত্তর নেই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে।
আলুর দাম কেন দি¦গুণ রাখা হচ্ছে জানতে চাইলে বকসিরহাটের আলু ব্যবসায়ী মো. জমির বলেন, ‘আমরা রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে আজকে আলু কিনেছি ৪২ টাকা কেজিতে তা ৪৫ টাকায় বিক্রি করছি। আর যেসব আলু ৭০ টাকা বিক্রি করছি তা কেনা বেশি পড়ছে’।
ব্যবসায়ী আবুল মালেক বলেন, ‘আজকের বাজারে মুন্সিগঞ্জের আলু বিক্রি করছি ৫০ টাকা, কুমিল্লার আলু ৬০ টাকা। যেগুলো বেশি কেনা পড়ছে, সেগুলো কমদামে বিক্রি করতে পারছি না। আপনারা পাইকার ও মজুদদারদের সাথে কথা বলেন।’
এদিকে আলুর চড়া বাজারে মধ্যস্বত্বকারবারি ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন মুন্সীগঞ্জ, নঁওগার মধ্যস্বত্ব কারবারি ও মজুদদাররা।
খাতুনগঞ্জের মোহাম্মদ বোরহান নামের এক মজুদদার বলেন, আমরা আজকে (শনিবার) আলু কিনেছি ৩৭ টাকার চেয়ে একটু বেশি। কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলুর দাম না কমালে আমাদের কম দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে আলুর দাম ২৩ টাকা হওয়ার কথা- এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ আড়তদার বলেন, ওই সংস্থা বললেও এ দামে কোথাও আলু মিলছে না। আগে তাদেরকে ওই দরে আলু দিতে বলুন, আমরা বিক্রি করতে রাজি।
মুন্সীগঞ্জের আলুর আড়তদার ও মধ্যস্বত্ব কারবারি সিরাজ ব্যাপারি বলেন, আলুর দাম আমরা বাড়াচ্ছি এমন দাবি চট্টগ্রামের পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা করে থাকলে তা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের প্রতি কেজি আলুতে লাভ থাকে ১ টাকা ২০ পয়সা। আজকে আলু কিনেছি সাড়ে ৩৭ টাকায়, গাড়িভাড়া ১৫ হাজার, দলিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। সবমিলিয়ে খরচ কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৮ টাকার বেশি। কেউ যদি বলে দাম বাড়তি নিচ্ছি তাহলে তারা কি প্রমাণ করবে আমরা কেমন দাম বাড়াচ্ছি।’
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম নাজের হোসাইন বলেন, শুধু আলু না। বাজারে প্রত্যেক কিছুরই দাম বাড়তি। এর পেছনে শক্তিশালী ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট জড়িত।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. মোশাররফ হোসাইন বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলু চাষ কম হয়েছে। ফলে মজুদদারদের হাতে কিছু আলু থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কোল্ড স্টোরেজে তেমন আলু নেই।
কৃষি অধিদপ্তরের মন্তব্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, এখন কোল্ড স্টোরেজগুলো তদারকি করা প্রয়োজন। তাহলে প্রকৃতপক্ষে স্টোরেজের আলু সংরক্ষণের হিসাব পাওয়া যাবে।