নিজস্ব প্রতিবেদক »
দীর্ঘদিন ধরে বাজার অস্থির থাকার পর সবজির যোগান বাড়াতেই কয়েক সপ্তাহ ধরে কমতির দিকে ছিল আলুর বাজার। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে আলুর বাজার। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে আড়ত পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১৩ থেকে ১৫ টাকা।
শনিবার দুপুরে অন্যতম ভোগ্যপণ্যের আড়ত খাতুনগঞ্জ ও রেয়াজউদ্দিন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশ কিছু আড়তে ভারতীয় আমদানির আলুর পাশাপাশি মুন্সীগঞ্জ ও নওগাঁর আলু মজুদ রয়েছে। এসব আলুর গুদামজাত করা হয় তিন সপ্তাহ আগে। যা বেপারি পর্যায় থেকে ভারতীয় আলু ২০ টাকা এবং দেশী চাষের আলু ২২ টাকায় কেনা হয়েছিল বলে জানা যায়। তাছাড়া আড়তপর্যায়ে যে আলু গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ২৩ থেকে ২৫ টাকায় তা গতকাল শনিবার বিক্রি হয়েছে ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা। আর খুচরা বাজারে তা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
সরকারি বাজার তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, শনিবার ভোক্তা পর্যায়ে আলু বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। যা গত মাসে বিক্রি হয়েছিল ২৬ থেকে ৩০ টাকা। আর গত বছর এদিনে বিক্রি হয়েছিল ১৬ থেকে ২০ টাকা। তথ্যমতে বছরের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে নতুন আলু বের হলেও সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছিলেন আড়তদারেরা। এমনকি ওইসময় বাজারে আলু বিক্রি করছিলেন ৭০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত। এতে বাজার পর্যায়ে সহনশীল রাখতে আলু আমদানি করতে বাধ্য হয় সরকার। বাজারে আমদানির আলু আসলে কমে যায় দাম। কিন্তু কমতির এ স্থায়িত্ব মাস দেড়েক পর্যন্ত থাকলেও চলতি সপ্তাহ থেকে আবারও আড়ত পর্যায়ে বাড়তে শুরু করেছে। দিন দিন আলুর অস্বাভাবিক দাম বাড়াকে খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের, আর পাইকাররা দুষছেন কোল্ড স্টোরেজ মালিকপক্ষ ও আমদানি সংকটকে আর কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষরা দুষছেন কৃষকদের।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা মো.জসিম বলেন, গত ১৫ দিন আগে পাইকারিতে মুন্সীগঞ্জের আলু কিনেছিলাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকা। আর গত সোমবার কিনেছিলাম ৩০ টাকায়। শনিবার আড়তদারেরা বিক্রি করছে ৩৭ টাকায়। দিন দিন আলুর দাম বাড়ছে। প্রশাসন এসে আমাদেরকে তদারকি করার ইঙ্গিত পেলে আড়তদারেরা গুদাম থেকে আলু সরিয়ে রাখেন এবং আমাদের বলেন সংকট রয়েছে। এভাবেই দাম বাড়ছে। প্রশাসনের আলুর আড়তগুলো তদারকি করা প্রয়োজন।
এদিকে আলুর দাম বাড়তি কেন জানতে চাইলে চাক্তাই আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফোরকান বলেন, ‘ভারতীয় আলু যতদিন বাজারে ছিল ততদিন আমরা সস্তায় কিনেছি আর সস্তায় বিক্রি করেছি। কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় আলু আড়তে নেই। যেসব আলু আছে তা দেশীয় চাষের আলু। যা মুন্সীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। তাছাড়া এখন কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কৃষকরা যদি বাড়তি দরে স্টোরেজে আলু বিক্রি করে আমাদের করার কিছু থাকে না।’
খাতুনগঞ্জের আলু আড়তদার মোহাম্মদ মোজাম্মেল বলেন, ‘আড়তে ভারতীয় আলু নেই। দেশীয় চাষের আলু কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মধ্যস্বত্ব কারবারিরা আমাদেরকে চড়া দর দিচ্ছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়াতেই আলুর দাম বাড়ছে। এ সবজির দাম স্বাভাবিক রাখতে হলে সরকারের আমদানির কোন বিকল্প নেই। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, গত বছর যেসব আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল তার দাম ছিল ৮ থেকে ১২ টাকা। এবার সেব আলু সংরক্ষণ করা হচ্ছে তা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় কেনা। কৃষকরা তাদের দর ছাড়ছে না। কাজেই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলুর দাম বাড়তে পারে।
এদিকে বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে দাম ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর ‘যৌক্তিক মূল্য’ নির্ধারণ করা হয় ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা। কিন্তু কৃষকরা মাঠেই বিক্রি করছেন ২৫ থেকে ২৭ টাকা।
আলুর উৎপাদনস্থল মুন্সিগঞ্জের যুগনীঘাটের কৃষক ও সরবরাহকারী মজিদ ব্যাপারির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, অন্যান্যবছর এদিনে যেভাবে আলু উৎপাদন হয়, এবছর সেভাবে হয়নি। তার মধ্যে মাঝখানে বৃষ্টির কারনে আবাদকৃত ফসল নষ্ট হয় দুইবার। তাছাড়া উন্নত জাতের বীজ না থাকায় আলুর উৎপাদন কমেছে, জমির উর্বরতার সমস্যা ও প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। কিন্তু প্রতিবছরই চাষের নানা উপকরণ, শ্রমিক বেতন বেড়েছে। যার ফলে কোল্ড স্টোরেজ কমদামে চাইলেও আমরা চাষের ফসল কমদামে বিক্রি করতে পারছি না।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবছর প্রতিকেজি আলু উৎপাদনের পেছনে খরচ হয়েছে ১৩ টাকা ৯০ পয়সা। গত মৌসুমে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ টন, আর চাহিদা ছিল ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। তবে হিমাগার সমিতির মতে, গত বছর ৯০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর চাহিদার চেয়ে ৩০ হাজার টন আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। তার মধে গত কিছুদিন আগেই ভারত থেকে আলু এসেছে। তাছাড়া নিয়মিত হিলি বন্দর দিয়ে আলু আমদানি হচ্ছে। বাজারে সংকট থাকার কথা নয়।