মহুয়া ভট্টাচার্য »
এবার ফাইনাল এক্সামে অংকে মাত্র ২৬ পেয়েছে রিভু। তার বন্ধুরা সবাই অ+। ক্লাসে এ নিয়ে টিচারের কাছে কম হেনস্তা হতে হয়নি আজ। কি করবে সে!? তার যে অংক এক্কেবারে মাথায় ঢোকে না! কেনো যে এই অংক সাবজেক্টটা সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়না। স্কুল থেকে ফেরার পর মাও ভীষণ বকুনি দিয়েছে আজ তাকে। তার বন্ধুরা সবাই এবার নতুন ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে যাবে, এসব ভাবতেই এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই রিভুর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। তার যে অংক মাথায় ঢোকে না কাকে বোঝাবে সে!? চট করে দেয়ালে টাঙ্গানো আইনস্টাইনের ছবিটাতে চোখ যায় তার। গতবছর জন্মদিনে বাবা এই ছবিটা উপহার দিয়েছিলেন রিভুকে। ছবিতে আইনস্টাইন তার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছেন। এই ছবি দেখে আরো বেশি রাগে কান্না পেয়ে গেলো রিভুর।
কান্নার গমক থামেই না যেন! কাঁদতে কাঁদতেই বালিশে মাথাটা যেই না এলিয়ে দিলো, অমনি সাদা ঝাঁকড়া চুল নাচিয়ে এক বুড়ো এসে হাজির রিভুর পাশে। সে চমকে তড়াক্ করে উঠে বসতেই দেখলো – আইনস্টাইন! রিভুর তো চোখ ছানাবড়া।
‘ আপনি’!
তক্ষুনি আইনস্টাইন ঝপ্ করে বিছানায় রিভুর পাশটাতে বসে বললেন –
‘হ্যাঁ খোকা, আমি। তুমি তখন আমার ওপর বেজায় রেগে গিয়েছিলে। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু ভাব করি।’
কী সর্বনাশ! উনি জানলেন কী করে তাঁর ভেংচি কাটা ছবি দেখে রিভুর ভীষণ রাগ হয়েছিল!? মুখ গুঁজে বসে রইলো সে। কি আর করবে। নতুন করে কাটা ঘায়ে নুন ছেটাতে এসেছেন – ওয়ার্ল্ড ফেমাস সাইন্টিস্ট। নিশ্চয় একঝুড়ি উপদেশ দিয়ে যাবেন। কি এক জ্বালা হয়েছে! এসব ভাবতে ভাবতে আইনস্টাইনের দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলো – মানুষটা কেমন উসখুস করছেন। একবার মাথা চুলকে নিচ্ছেন। আবার এদিক ওদিক পায়চারি করছেন। হঠাৎ আবার রিভুর খাটের নিচে কি যেন খুঁজছেন। রিভু জিজ্ঞেস করলো –
‘কি খুঁজছেন আপনি?’
আইনস্টাইন চিন্তিত মুখ নিয়ে বললেন –
‘আচ্ছা খোকা, তুমি আমার সম্পর্কে পড়েছো বই – পত্রে? কিছু জানো আমার কথা?’
এবার রিভুর রাগ সামলানো দায়। বিশ্বখ্যাত, নামজাদা বিজ্ঞানী কিনা! তাই খুব গুমোড়। তাঁর সম্পর্কে পড়তেই হবে যেনো! পড়াশোনায় ফার্স্ট ছিলেন হয়তো, তাই এতো অহংকার। সে বিরক্ত মুখে বলল –
‘না। আমি আপনার সম্পর্কে পড়িনি কিচ্ছু।’
আসলে রিভু মায়ের বকুনি খেয়ে অভিমানে মিছেমিছি বলছে এসব। সে তো আইনস্টাইন পড়েছে। আর রিভুর প্রিয় সাবজেক্ট এস্ট্রোলজি। সে মহাকাশ বিজ্ঞানী হতে চায়। এসব কথা সে আইনস্টাইনকে বলতে যাবে কেন!? কিন্তু আইনস্টাইন বড্ড মন খারাপ করে বললেন,‘তুমি যদি একটু আমার সম্পর্কে বই পত্রতে পড়তে, আজ আমার ভীষণ উপকার হোতো।’
– ‘বাহরে! আমি পড়লে আপনার উপকার হোতো!?’
– ‘হ্যাঁ খোকা। আমি একটি কি জিনিস যেন ভুল করে কোথায় ফেলে এসেছি, কিছুতেই জিনিসটার নাম মনে করতে পারছিনা।’
এই বলে আইনস্টাইন ফের মাথা চুলকোতে লাগলেন। রিভুর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন,
– ‘নাহ্! মনে পড়ছেনা কিছুতেই। আরে, তুমি একটু মাথা খাটাওনা বাপু। ঐ যে ছরটানা একটা যন্ত্র, আমি সবসময় বাজাই!? যাতে আমি সুর তুলি?’
রিভুর তো আক্কেল গুড়ুম হবার যোগাড়। আইনস্টাইন খুব ভালো ভায়োলিন বাজাতেন, তা রিভু বইতে পড়েছে। সে বলল, ‘আপনি বোধহয় আপনার ভায়োলিনটা খুঁজছেন।’
ভায়োলিনের নাম শুনেই আইনস্টাইন লাফিয়ে উঠলেন প্রায়।
– ‘দেখেছো! এতক্ষণ মনেই পড়ছিলো না!ভাগ্যিস তুমি মনে করিয়ে দিলে।’
– ‘এতো ভুলো মন আপনার! নিজের ভায়োলিনের নাম মনে করতে পারছিলেন না!? ’
– ‘আর বোলো না। এই ব্যামো আমার ছোটবেলা থেকেই। এই তোমার মত বয়সেই কি হাবাগোবা, গোবেচারা ছিলুম, তা তুমি ভাবতে পারবেনা। কিচ্ছু মনে থাকতো না আমার, জানো!? স্কুলের মিস্ট্রেসরা তো প্রায়ই বলতেন ‘এই বোকা ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ একে তো বোকা, তার ওপর তোতলানোর জন্য মুখে কথাই আসতো না। কি অবস্থা ভাবো একবার!?’
রিভুর মুখে তো আর রা’ সরে না। অবাক হয়ে বলে, ‘কি সাংঘাতিক!’
– ‘তোমায় তাহলে আর বলছি কি!? শোনই না! ছোটবেলায় আমার পড়াশোনা মনে থাকতো না মোটেই। ক্লাসের বন্ধুরা এ নিয়ে আমার পেছনে লাগতো ভীষণ।’
রিভুরও তো একই দশা হোলো আজ। অংক স্যারের বকুনিগুলো কি আর ভোলা যায়!? আইনস্টাইন কিন্তু ঠিক বুঝে ফেললেন রিভুর কষ্ট। টুপ্ করে রিভুর আদুরে গালটাতে আলতো টোকা দিয়ে বললেন – ‘মন খারাপ কোরো না খোকা। তোমার যা পড়তে ভালো লাগে, তাই পড়বে। চোখের জল, অভিমানে মুখ লুকিয়ে থেকো না। আমায় দেখ? কতজনই তো হাসি ঠাট্টা করতো আমার ভুলোমন আর বোকামির জন্য। তা বলে কি আমি থেমে গেছি? মোটেই না। কখখনো থেমে যাওয়া চলবে না। মনের জোর আর একাগ্রতা হারাতে নেই কখনো। সব সময় মনের কথা শুনতে হয়। যে কাজে মন সাঁয় দেয় তাতেই মানুষের সফলতা আসে। আর, পড়াশোনা কি কেবল নম্বর পেতে!? ক্লাসে ফার্স্ট হতে!? না গো খোকা! পড়াশোনা করতে হবে মনের আনন্দের জন্য। এই যে দেখো তোমার আকাশের তারা, গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, নীহারিকা নিয়ে পড়তে, জানতে ভালো লাগে। এ তো তুমি মনের আনন্দেই পড়, তাই না!? এইভাবেই এগিয়ে যেতে হয়। এতে ব্যর্থতা আসলেও থেমে যেতে নেই।’
এখন রিভুর আর তেমন রাগ হচ্ছে না মোটেই। বরং আইনস্টাইনকে তার খুব আপন,কাছের কেউ মনে হতে লাগলো। আইনস্টাইন তার সব মনের কথা জানেন। আর অত বড় বিজ্ঞানী বলে কিন্তু এতটুকু বড়াই নেই তাঁর মনে! রিভুর মুখে একটু প্রশান্তি আসতে দেখে আইনস্টাইন তাঁর প্রিয় ভায়োলিনটা হাতে তুলে নিলেন। কী সুন্দর মিষ্টি ভায়োলিনের সুরে রিভুর চোখে ঘুম নেমে এলো। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙতেই দেখলো, মা খাবার হাতে দাঁড়িয়ে। দেয়ালে আইনস্টাইন তেমনি ভেংচি কেটে রয়েছেন এখনো। রিভু মায়ের কোলে মুখগুঁজে অনেকক্ষণ মায়ের আদর খেলো। মা ও বকুনির দশগুণ আদর দিয়ে বললেন, ‘হয়েছে অনেক! খেয়ে দেয়ে এবার পড়তে বোসো।’ রিভু মায়ের গলা জড়িয়ে বলল, ‘এবার থেকে মন দিয়ে পড়বো। আর তোমার অবাধ্য হব না।’