সুপ্রিয় দেবরায়
সারাদিন খাটুনির পর রুমিয়া তার সাত বছরের ছেলে টুকাইকে খাতায় কয়েকটি বাক্য ‘আমি মিথ্যা কথা কখনও বলব না’, ‘আমি কখনও কোনো অসৎ কাজ করব না’, ‘আমি কখনও কাউকে ঠকাব না’ লিখতে দিয়ে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা একটু মেলেছে। টুকাইয়ের স্কুল থেকে হোমটাস্ক দিয়েছে, প্রত্যেকটি বাক্য দশবার করে লিখতে হবে।
আধা-শহর আধা-গ্রাম্য ন্যায়পুরের একটি মাত্র হাইস্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে টুকাই পড়ে। রুমিয়ার শ্বশুর মশাই আদিত্য নারায়ণ এই স্কুলেই তিরিশ বছর শিক্ষকতা করে বছর দশেক আগে অবসর নিয়েছেন। অংকের শিক্ষক ছিলেন। একজন আদর্শবান, কর্তব্যপরায়ণ, অন্যায়ের সাথে আপোষহীন শিক্ষক হিসেবেই ওনার পরিচিতি এই ন্যায়পুরে। সবাই বলাবলি করে, এই জায়গাটির নামের সার্থকতা ওনার চরিত্রটিকে ঘিরেই। ওনার হাতেগড়া অনেক সফল ছাত্রছাত্রী আজ দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠিত। ওনার দাদার ছেলে দেবেন্দ্র নারায়ণ অল্পবয়সে তার বাবা-মাকে হারালে উনি দাদার ছেলেটিকে নিজের সন্তান রথীন্দ্র নারায়ণের সাথেই সন্তান স্নেহে মানুষ করেছেন। আজ সে সিডনিতে তার পরিবার নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। আইআইটি কানপুর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করে সিডনি চলে যায়। খুব সম্ভব সে আর এদেশে ফিরবে না। দুই-তিন বছর পরপর একবার করে ঘুরে যায়। জমিসহ এই পৈতৃক ভিটেটির একটি অংশ আদিত্য নারায়ণের দাদার। শ্বশুর মশাই একবার বলেছিলেন, দেবেন্দ্রর অংশের জমিটির দাম আজকের বাজার দর অনুযায়ী কুড়ি লাখের ওপর হবে। বছরখানেক আগে যখন দেবেন্দ্র দেশে আসে, তখন সে তার কাকা আদিত্য নারায়ণকে পাওয়ার-অফ-এটর্নি দিয়ে যায় আর বলে যায়, যদি সম্ভব হয় জমিটি বিক্রি করে দিতে। পৈতৃক বাড়িটিতে তার অংশ তো থাকলোই। যখন আসবে এখানে এসে থাকবে। জমিটি বিনা কারণে রাখার কোনো অর্থ হয় না, যখন সে এবং তার পরিবার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে এবং এদেশে ফেরার কোনো ইচ্ছে আর নেই। আর তাছাড়া বয়সের ভারে আদিত্য নারায়ণের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না এই জমিটির দেখাশোনা করার। আর নিজের ছেলে রথীন্দ্র বিগত আট বছর ধরে চাকরির সুত্রে থাকে বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকার এক স্কুলে সে বাংলার শিক্ষক। রথীন্দ্র অল্পবয়স থেকেই বাবার মতন শিক্ষক হতে চেয়েছিল। প্রথমে ন্যায়পুরের পাশের শহর সন্ধানপুরের স্কুলে শিক্ষক ছিল। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় তার বদলি হয়ে যায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। এরপর অনেক চেষ্টা করেছে এদিকে চলে আসার। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আদিত্য নারায়ণও চেষ্টা করছেন ওনার পরিচিতজনের সূত্র ধরে। কিন্তু সেরকম আশার আলো এখনও পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি।
বদলি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রুমিয়া গিয়েছিল রথীন্দ্রর সাথে বাঁকুড়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। কয়েক মাস ছিল। খুব সুন্দর কেটেছিল সেই দিনগুলি। কিন্তু একটাই অসুবিধে। ওই গ্রামে থাকার মতো সেরকম কোনো পাকাবাড়ি নেই। সবই টিনের অথবা টালির চাল দেওয়া। তাতেও রুমিয়ার অসুবিধা ছিল না। কিন্তু কেউ সেই বাড়িও ভাড়া দিতে চায় না। সব বাড়িগুলিই ছোট, এক কামরা অথবা দেড় কামরার। সেখানেই রান্না, সেখানেই শোয়া। নিজেরাই কোনো রকমে গুঁজেমুজে থাকে। তবে ইলেক্ট্রিসিটি আছে সেই গ্রামে, এটাই রক্ষে। আর সবচেয়ে অসুবিধা, সকালের শারীরিক ত্যাগ কর্মগুলি করতে মাঠেঘাটেই যায় এই গ্রামের লোকগুলি। রথীন্দ্র জানে, রুমিয়ার পক্ষে এই কর্মটি করা সম্ভব নয়।
আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মধ্যে একটি মাত্র স্কুল। অনেকেই চার-পাঁচ মাইল হেঁটে আসে স্কুলে পড়তে। রথীন্দ্ররা থাকতো স্কুলের সাথে যুক্ত একটা মেস বাড়িতে। লোকাল কর্মচারী ছাড়া স্কুলের কর্মরত প্রায় সবাই মিলে থাকতো সেখানে। ওই গ্রামে থাকার জন্য সেরকম কোনো পাকাবাড়ি না থাকার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলভবনের একটি অংশের কয়েকটি ঘর মিলিয়ে এই মেস বাড়িটি বানানোর ব্যবস্থা করে। না হলে এখানে এসে কেউ থাকবে না। কিন্তু এখানে পরিবার নিয়ে থাকার অনুমতি নেই। তাই রুমিয়া আসার আগে রথীন্দ্র কয়েক মাসের জন্য গ্রামের প্রধানকে বলে তাঁর বাড়ির একটি অংশ চেয়ে নেয়। প্রধানের বাড়ির পুকুরের ধার ঘেঁষে এই টালির ছাদ দেওয়া বাড়িটি। আশপাশ ঘিরে বেশ কয়েকটি আম-জাম-নারকেল-নিম গাছ। ভোররাত থেকেই পাখপাখালির গুঞ্জন। বাগানের শেষে লাইন দিয়ে খাটা পায়খানার ব্যবস্থা, চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা। তার সাথেই টেপাকল। মন্দের ভালো, মাঠেঘাটে যেতে হয় না। রুমিয়ার বাড়িটি দেখেই পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রামের প্রধান কয়েক মাসের জন্য রথীন্দ্রকে থাকতে দিয়েছেন। কারণ এখানে উনি ওনার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডার আসর বসান। রুমিয়া অনুরোধ করাতেও সম্মত হননি। বলেছেন, মাঝেমাঝে এসে থাকতে পারো, পাকাপাকিভাবে নয়। কী করা যাবে, তাই সই। রান্নার সমস্ত সরঞ্জাম, বাসনপত্র প্রধানের বাড়ি থেকেই আসে। বিয়ের পর রুমিয়ার সবচেয়ে ভালো সময় এখানে কেটেছিল।
সেদিন ছিল রবিবারের বিকেল। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। বাসন মেজে পুকুরের ঘাটলায় একটা ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরছে। কোমরের ভাঁজে ধরা এককাড়ি বাসন বামহাতের বেড় দিয়ে। শরীরের সাথে লেপ্টে ভেজা শাড়িটি। পায়ে পায়ে ভেজা শরীরের জলবিন্দু ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। রথীন্দ্র শুয়ে আছে উপুড় হয়ে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে। বউয়ের এই ভেজা শরীরে পথচলা একটা সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে তার ভিতরে। ঠিক যেন সেই গ্রাম্যবধূটি, যেমন দেখেছে সিনেমাতে।
রাতের আঁধারে গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে ওঠে। হিমেল হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে গাছগাছালিতে। রাতজাগা পাখি ডানা ঝাপটায়। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে শব্দ করে। শরীরে ক্ষীণ ঢেউ তুলে পরনের কাপড়ের সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে রুমিয়া পাশ ফেরে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ে। সাথে বৃষ্টির কুচি মেশানো হিমেল বাতাস। রুমিয়া এবার চিত হয়। তখনই বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুতের ঝলকানি আলোয় রুমিয়ার একচিলতে উঠোন আলোকিত হয়ে ওঠে মুহূর্তেই। পরম সুখে, আবেশে চোখ বুজে আসে রুমিয়ার।
এক মাসের ওপর কেটে গেছে। রুমিয়া জানায় সে গর্ভবতী। রথীন্দ্রর সাথে ফিরে আসে ন্যায়পুরে। এরপর রুমিয়া আর একবারও যায়নি রথীন্দ্রর চাকরিস্থলে। রথীন্দ্রই এক-দেড়মাস অন্তর ছুটিছাঁটায় ন্যায়পুরে এসেছে।
মা, ও মা ওঠো। কখন থেকে ঠাম্মি ডাকছে তোমাকে। টুকাইয়ের ডাকে ধড়ফড় করে ওঠে বসে রুমিয়া। পুরোনো একান্ত আপন সুখস্মৃতির রোমন্থন করতে করতে কখন যে চোখ দুটো একটু জড়িয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি। তাড়াতাড়ি করে চোখেমুখে একটু জলের ঝাপটা দেয়। বসার ঘরে রথীন্দ্রর বাবা-মাকে কাঠের সোফাটাতে বসে থাকতে দেখে। কিছু একটা আলোচনা করছিলেন, বুঝতে পারে। রুমিয়াকে দেখেই শ্বশুর মশাই বলে ওঠেন, বুঝলে বউমা, তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে। সেটাই এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম তোমার শাশুড়ি মায়ের সাথে। রুমিয়া একটা মোড়া টেনে বসতে বসতে জানতে চায়, কী সুখবর, বাবা?
আজ আমি সন্ধানপুরের স্কুলে গিয়েছিলাম। সেক্রেটারি মশাই আজ স্কুলে এসেছিলেন। এর আগেও বেশ কয়েকবার ওনার সাথে রথীন্দ্রর ব্যাপারে কথা হয়েছিল। আজ হেডমাস্টারের ঘরে কথা হোল। উনি এবার আশার আলো দেখিয়েছেন। ওই স্কুলের বাংলার শিক্ষকের সাথে বেশ কিছুদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। যদিও উনি বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলা পড়াচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি উনি স্কুল সংস্কার নিয়ে নিয়ম-কানুনের কিছু রদবদল চাইছেন। সেটা নিয়ে অবশ্য সেক্রেটারি মশাই বিস্তারিত কিছু আলোচনা করলেন না। কিন্তু শিক্ষকটির দলে নাকি ভিড়েছে উঁচুক্লাসের বেশ কয়েকজন ছাত্রও। তাই হেডমাস্টার মশাই এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ বাংলার শিক্ষককে স্কুল থেকে সরাতে চান। এই শিক্ষকটির পরিবর্তে, ওনারা রথীন্দ্রর নাম সুপারিশ করতে পারেন। আর তাছাড়া এখানে রথীন্দ্র আগে শিক্ষকতাও করেছে। সবাই ওকে পছন্দও করেন। সেক্রেটারি মশাইয়ের জানাশোনা আছে শিক্ষা দপ্তরের উঁচুমহলে। তবে খুব সম্ভব হয়ত লাখপাঁচেক খরচা করতে হবে।
রুমিয়া এতক্ষণ শ্বশুর মশাইয়ের কথা শুনে বেশ উৎসাহবোধ এবং আনন্দিত হচ্ছিল। কিন্তু শেষবাক্যটি শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। তাহলে টিভিতে যা দেখাচ্ছে কিম্বা সংবাদপত্রে যেসব দুর্নীতির খবর বেরোচ্ছে, সব সত্যি! টাকা দিয়ে তাহলে চাকরি কেনা যায়! নিজের পছন্দমতো জায়গায় পোস্টিং নেওয়া যায়! কিন্তু রুমিয়ার সবচেয়ে অবাক হবার পালা, রথীন্দ্রর বাবার মতন আদর্শবান একজন শিক্ষক এ কথা কী করে বলছেন!
রুমিয়া মেঝেতে নিজের ডানপায়ের বুড়ো আঙুল ঘষটাতে ঘষটাতে আর নিচে সেদিকে তাকিয়েই বলে, কিন্তু বাবা, যে বাংলার শিক্ষকটি এখন পড়াচ্ছেন তার প্রতি অন্যায় করা হবে না? হয়ত সেক্রেটারি মশাই ঠিকই ওনাকে সরিয়ে দেবেন। কিন্তু তাতে আমরা কেন ভাগীদার হবো? আর তাছাড়া, এত টাকা আসবে কোথা থেকে ?
সেটারও ব্যবস্থা হয়ে গেছে, মা। দেবেন্দ্রর জমিটার একজন খদ্দের পাওয়া গেছে। বাইশ লাখ টাকায় কিনবে।
তার মানে আপনি দেবেন্দ্র দাদাকে ঠকাবেন?
তা নয় মা। আমি ওকে জানিয়েই টাকাটা নেব। পরে ধীরে ধীরে আমি আর রথীন্দ্র মিলে ফেরত দেব।
সেটা সম্ভব নয় বাবা। সেটা আপনিও জানেন, আমিও জানি। এবং এটাও জানি, দেবেন্দ্র দাদা কোনোদিন এই টাকা আমাদের থেকে ফেরত নেবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা জেনেশুনেই আমরা দেবেন্দ্র দাদাকে ঠকাচ্ছি।
তাহলে কী করবো মা, তুমিই একটা বিধান দাও। আমরা যে আর তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। রথীন্দ্রটাও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বাবার আদর-ভালোবাসা সেভাবে পেলই না আমাদের দাদুভাই। এখন বড় হচ্ছে সে। বাবার সঙ্গ দরকার তার এখন।
রুমিয়া এতক্ষণ মুখ তোলেনি। নিচের দিকেই তাকিয়েছিল। যে শ্বশুর মশাইকে সে এতদিন চিনতো, তাঁর দিকে তাকিয়ে ওনার মুখ থেকে নিঃসৃত কথাগুলি শোনার সাহস সে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, শ্বশুর মশাইয়ের এই কর্মকা-ের আসল কারণ।
রুমিয়া এবার শ্বশুর মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, জানেন বাবা, আমি বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে টিভি দেখি না। সংবাদপত্র পড়ি না। রোজ তো একই খবর। দুর্নীতি আর দুর্নীতি। আমরা ঘুষখাওয়া লোকগুলিকে গালি দেই। কিন্তু এই লোকগুলির দালালদের থেকে জানতে চাই, কত দিলে চাকরিটা হবে? আর এই লাখ-লাখ টাকাটা জোগাড় করতে আমাদেরও নিশ্চয়ই হিমশিম খেতে হয়। সহজ উপায়ে এত টাকা কি সবার ক্ষেত্রে আসে! অর্থাৎ আমরাও কাউকে ঠকিয়ে কিম্বা অসৎ উপায়ে টাকাটা জোগাড় করি। টিভির সামনে বসে থাকি উদগ্রীব হয়ে তাদের কীর্তিকাহিনী, কার্পেটের তলায় লুকোনো প্রণয়কাহিনি শুনতে। মজা পাই, হাততালি দেই। তারপর সেটা ফরওয়ার্ড করি সামাজিক মাধ্যমে একটা স্মাইলির সাথে। কোনও নেতা দুর্নীতিতে লিপ্ত লোকের পাশে দাঁড়ালে, কোনও নেতা সাম্প্রদায়িকতার বীজবোনার চেষ্টা করলে, কোনও নেতা দলবদলের খেলায় মেতে উঠলে আমরা তাদেরকেই হিরো বানাই। তাদের ঝুলিতেই ভোটটি দিয়ে আসি। কেউ আবার একদলে তো তার প্রেমিক কিম্বা প্রেমিকা বিরোধী দলে। অর্থাৎ গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে। ভোটের আগে বসে থাকি বিভিন্ন রকম প্রকল্প কিম্বা ভা-ার থেকে ঘোষিত অনুদানের অপেক্ষায়। কারণ ভোটটা তো সেভাবেই দিতে হবে। এককালের সুপরিচিত শিক্ষক-অধ্যাপক, আজকের রাজানুগ্রহপ্রাপ্ত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ওনারা, কষ্ট হয় তাঁদের কথা ভাবলে।
একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলে রুমিয়া হাঁপাচ্ছিল। একটু দম নিয়ে আবার বলা শুরু করে, বাবা মনে আছে, আপনি আমাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন আগে। আর্যদের ভারতবর্ষে আগমনের কাহিনি নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত) লিখেছিলেন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আমিই সে’। বইটির কাহিনির কথা বলছি না। কিন্তু কেন জানি না উপন্যাসটির নামটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। মনে হয় খুবই প্রযোজ্য এই উপন্যাসের নামটি আজকের রাজনৈতিক আবহাওয়ায়। মনে ভাবের উদ্রেক হয়, হ্যাঁ ‘আমিই সে’। আমি মানে আমজনতা, অর্থাৎ আমি এবং আপনি। আমি মানে ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতা। আমি মানে রাজনৈতিক নেতার তোষণকারী, রাজানুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তি অর্থাৎ এক কথায় খয়ের খাঁ। চারদিকে চেয়ে দেখি দুর্নীতির স্তূপ। আমার, আপনার, নেতাদের মুখে অসততার ছায়া, দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিভ্রষ্ট, সুবিধেবাদী, ধান্দাবাজ। লোককে ঠকিয়ে, উপযুক্ত লোককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে, অসৎ উপায়ে আর একটু সুখে বেঁচে থাকতে চাওয়ার ইচ্ছে, যেটা হয়ত আমাদের প্রাপ্য নয়। বাবা, আমরা কেউই চাই না যে আপনি আমাদের জন্য হয়ে যান ‘আমিই সে’। আপনার ছেলে সমস্ত নিয়ম মেনেই চেষ্টা করছে বদলির জন্যে। জানিয়েছে কিছুদিন আগে, হয়ত এখানে অথবা সন্ধানপুর স্কুলে হবে না। কিন্তু আশেপাশের কোনো একটা স্কুলে হবে।
তুমি আমাকে বাঁচালে মা। আমিও ঠিক ভিতর থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। কিন্তু তোমাদের মুখগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলেই, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি ঝোঁকের মাথায় এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছিলাম, সারাজীবন এর জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আয়নাতে নিজের দিকে তাকাতে পারতাম না। আমি আজ গর্বিত মা, তোমার এই চিন্তাধারার জন্য।
আরও কিছু হয়ত উনি বলতে যাচ্ছিলেন। রুমিয়া হঠাৎ আসছি বাবা বলে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
একটু পরেই একটা খোলা খাতা শ্বশুর মশাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেয়।
দেখুন বাবা, আজকে টুকাই এই বাক্যগুলি দশবার করে লিখেছে। স্কুল থেকে লিখতে দিয়েছে। আপনি অংকের শিক্ষক হয়েও এই বাক্যগুলি হয়ত অনেকবার আপনার ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছেন। এর অর্থ বুঝিয়েছেন। কারণ, মনেপ্রাণ আপনি এতে বিশ্বাস করেন।
সরল অক্ষরে লেখা টুকাইয়ের খাতার পাতাগুলির দিকে তাকিয়ে আদিত্য নারায়ণের চোখ ভিজে আসে। যার এ রকম সৎ মানসিকতার অধিকারী বউমা, তার পক্ষে কি কোনো দিন সম্ভব ‘আমিই সে’ হতে।