মো. মোরশেদুল আলম »
কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করতে চাই। “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?/ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/ এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।”২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর (সুবর্ণ জয়ন্তী) উদযাপন করবে বাংলাদেশ। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালির অস্তিত্ব, ঠিকানা ও আবেগের অপর নাম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা বাঙালির রক্তঝরা এক ইতিহাস। বাঙালির স্বাধীনতা ইতিহাসের এক মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের মহানায়ক হচ্ছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যাওয়ায় দীর্ঘ ১৯০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয় বাঙালি জাতিকে। দীর্ঘ সময়ের পরাধীনতার শাসনে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী জোরালো আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনতার মহাকাব্যিক ইতিহাসে আমরা দেখি ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ওয়াহাবী আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, পূর্ণ স্বরাজ, স্বদেশী আন্দোলন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রভৃতি। এছাড়াও দেখি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ, অনুশীলন সমিতি, ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ, আজাদ হিন্দ ফৌজ, যুগান্তর, স্বরাজ্য দল প্রভৃতি সংগঠন। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় আরও দেখি তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, ক্ষুধিরাম, সূর্য সেন ও প্রীতিলতা প্রমুখ সংগ্রামী নেতাদের। মহাত্মা গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, এ. কে. ফজলুল হক, জওহর লাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দও স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। তবে, বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে কিন্তু চূড়ান্তভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল মুসলিম লীগ উত্থাপিত সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিত্ত্ব বা লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০ খ্রি.)। প্রস্তাবটির মাধ্যমে ধর্মকেই রাষ্ট্র ও জাতীয়তা নির্ধারণের নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক রীতিনীতি ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা এক জাতিভুক্ত, এ ধারণাটি কাজ করেছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্যোক্তাদের মধ্যে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। পূর্ব ও পশ্চিমের হাজারো মাইল ব্যবধানে শুধুমাত্র ধর্মীয় বন্ধনে গঠিত এ রাষ্ট্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যায় খাটে না। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এ দু’অঞ্চলের অবস্থান এক নয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি অংশ হিসেবে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক যাত্রা শুরুর অব্যবহিত পরই বলতে গেলে স্বাধীনতার পটভূমি রচিত হয়। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের এ দুই অংশের জনগণের মধ্যে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম ছাড়া আর সকল বিষয়েই অমিল ছিল। তদুপরি পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীগত সাদৃশ্য তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষাপটে রচিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এ ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ‘না’ ‘না’ বলে এর প্রতিবাদ করে। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগান দেয়। পুলিশ এক পর্যায়ে মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ অনেকে শহিদ হন। ১৯৫২ সালের একুশের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। পরবর্তীতে পূর্ববাংলার ’৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে বাঙালি এক অভাবনীয় ধস নামানো বিজয় অর্জন করে। ’৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেন। ৬ দফা কর্মসূিচ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এভাবেই তিনি অচিরেই ‘ক্যারিশমেটিক লিডার’ এ পরিণত হন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা মামলা দায়ের করে। তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলাটি পূর্ববাংলার জনগণের মনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের বীজ বপন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তীব্র আন্দোলনের চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে।
১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতাদেশ হওয়ার পর মূলত পূর্ববাংলার শাসন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে সাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঐতিহাসিক এ ভাষণে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আহ্বান জানিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক নীল নকশা অনুযায়ী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার পূর্বে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২:২০ মিনিটে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত স্বাধীনতার এ ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ হচ্ছে: “এটাই হয়ত আমার শেষবার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।”
বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণ সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লক্ষেরও অধিক শহিদ এবং ৩ লক্ষেরও অধিক মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে চূড়ান্ত স্বাধীনতা। বিশে^র মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বিশ্বের উন্নত দেশের চেয়েও এই সংকট ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কর্মকা-ের ভূয়সী প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, জীবন মানের উন্নয়ন, ব্যাংকের রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, প্রবৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এগিয়ে গেছে প্রিয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে রাজনৈতিক মুক্তি প্রদান করেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্রকে জয় করে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রদান করার মধ্য দিয়ে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের বাস্তবায়নে আমাদের সকলকেই স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশ একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও উন্নত দেশে পরিণত হবে, মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়