আবদুল্লাহ আল মামুন : মঞ্চের মহারথি মানবিক চিত্রশিল্পী

মো. রবিন ইসলাম »

আবদুল্লাহ আল মামুন ( ১৩ জুলাই ১৯৪২-২১ আগস্ট ২০০৮) বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে এক অমর নাম। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার ও নাট্যশিক্ষক। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই সাহিত্যসাধক তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেছেন বাঙালির আত্মপরিচয়, সমাজবাস্তবতা এবং মনন-সংকট।

তিনি জন্মগ্রহণ করেন জামালপুর জেলার আমড়া পাড়ায়। পিতা ছিলেন অধ্যক্ষ আবদুল কুদ্দুস এবং মাতা ফাতেমা খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই নাট্যচর্চার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হন, যা আজ তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রথম নাট্য রচনা ‘নিয়তির পরিহাস’ (১৯৫৭), এবং প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘সুবচন নির্বাসনে’ (১৯৭৪), ‘এখনও দুঃসময়’ (১৯৭৫), ‘সেনাপতি’ (১৯৮০), ‘তৃতীয় পুরুষ’ (১৯৮৮), ‘মেরাজ ফকিরের মা’ (১৯৯৭), ‘জন্মদিন’ (২০০৬) ইত্যাদি। তাঁর নাটকের বিষয় ছিল সমাজের অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব, শ্রেণি-সংগ্রাম, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আত্মপরিচয়ের সংকট।

তিনি শুধু মৌলিক নাটকই রচনা করেননি; বরং ক্লাসিক সাহিত্যকর্মকে নাট্যরূপ দিয়ে সেগুলোর নির্দেশনা ও অভিনয়ও করেছেন। যেমন,বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, শেক্সপিয়রের ওথেলো (ইয়াগো চরিত্রে), সোফোক্লিসের আন্তিগোনে (ক্রেয়ন চরিত্রে)।

তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় অবদানের একটি হল সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের নির্দেশনা, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক কাব্যনাট্য হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।

আবদুল্লাহ আল মামুন ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক নাটক নির্মাতা। তাঁর পরিচালিত ও প্রযোজিত ধারাবাহিক নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য,

সংশপ্তক (২৬ পর্ব), ঘরোয়া (৫২ পর্ব), জোয়ার ভাটা (২০০ পর্ব), বাবা (২০০ পর্ব), উত্তরাধিকার, জীবনচিত্র, আমি তুমি সে প্রভৃতি।

এই নাটকগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের টেলিভিশন নাটকে জীবনঘনিষ্ঠ চিত্র, পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরেন।

আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো সারেং বউ, সখী তুমি কার, এখনই সময়, জনমদুখী, দুই জীবন, দমকা, বিহঙ্গ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে শিল্পমানের দিক থেকে অনন্য। সমাজের নানা স্তরের মানুষ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিকূলতায় টিকে থাকার লড়াই তাঁর সিনেমার প্রধান উপজীব্য।

তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ফেরদৌসী মজুমদার: জীবন ও অভিনয় বাংলাদেশের থিয়েটার ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ।

আবদুল্লাহ আল মামুন শুধু নাট্যকার নন, একাধিক উপন্যাসের রচয়িতাও। তাঁর উপন্যাসগুলো, মানব তোমার সারাজীবন (১৯৮৮), আহ্ দেবদাস (১৯৮৯), তাহাদের যৌবনকাল (১৯৯১), হায় পার্বতী (১৯৯১), এই চুনীলাল (১৯৯৩), গুণ্ডাপাণ্ডার বাবা (১৯৯৩), খলনায়ক (১৯৯৭) সমাজবাস্তবতাকে গভীরভাবে অনুধাবন করে রচিত।

আত্মজীবনী আমার আমি এবং ভ্রমণকাহিনী ম্যানহাটান তাঁর বহুমুখী চিন্তার দ্যোতক। নাট্যশিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর শিক্ষামূলক গ্রন্থ অভিনয় (প্রথম খণ্ড) আজও সমাদৃত।

তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিনিয়র প্রযোজক, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (১৯৬৬-১৯৯১)। পরে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (১৯৯১-২০০১) এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে (২০০১) রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।

তাঁর গৌরবময় কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বহু সম্মাননায় ভূষিত হন।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯), জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৮), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (বিভিন্ন বিভাগে একাধিকবার), একুশে পদক (২০০০), মুনীর চৌধুরী স্মৃতি সম্মাননা, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পদক প্রভৃতি। ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুল্লাহ আল মামুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬৫ বছর।

আবদুল্লাহ আল মামুন আমাদের সংস্কৃতির এক নীরব স্থপতি। তিনি ছিলেন সময়ের কণ্ঠস্বর, মানুষ ও সমাজের গভীর পর্যবেক্ষক। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁর মতো বিশাল মাপের একজন শিল্পীকে আজ আমরা বিস্মৃতির অতলে হারাতে বসেছি।

আজ জরুরি তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করা, তাঁর লেখা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা, তাঁর ভাবনাকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। কারণ, আবদুল্লাহ আল মামুন শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি শিল্প-ঐতিহ্য ও একটি চেতনার নাম।