আপ্যায়ন

জসিম উদ্দিন মনছুরি »

চট্টগ্রাম অঞ্চলে শ্বশুরবাড়িতে আপ্যায়নের রেওয়াজ দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ। শাশুড়িরা জামাই আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেন না। এর আগেও কবির শ্বশুর বাড়িতে বেশ কয়েকবার নিমন্ত্রণ খেয়ে ধন্য হয়েছে। শাশুড়ি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের মেয়ে। নানা শ্বশুর, মামা শ্বশুর ও কবিরের নিজের শ্বশুরেরও প্রসিদ্ধি আছে। চট্টগ্রামের লোকেরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে কিন্তু কবির সাহেবের শ্বশুর রুচিশীল। তার ফ্যামিলির সবাই শুদ্ধভাষায় কথা বলে। এ নিয়ে কবিরের শশুর তিক্ত রাসেলের অহংকারের শেষ নেই। কবিরের শ্বশুরকে গ্রামে সবাই ‘তিক্ত রাসেল’ বলে চেনে। এ নামটা কীভাবে হলো, কারো জানা নেই। তবে রাসেল সাহেব এত বেশি তেজী কথা বলেন যে, যে কেউ বিরক্ত না হয়ে পারে না। হয়তো তাই গেরামের বুদ্ধিজীবীরা এই নাম দিতে পারে বলে গেরামের বিশেষজ্ঞদের এমন ধারণা।
রাসেল সাহেবের একটি মাত্র কন্যা। মেয়েকে ইন্টার পড়ার পর বিয়ে দিতে তোড়জোড় পাকাতে থাকেন। তাদের পাহাড়ি টিলায় নিত্যনতুন অতিথির আগমন ঘটে। মেয়ে শ্যামবর্ণ, মাঝারি গঠন, মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। কিন্তু তিক্ত রাসেলের তিক্ত স্বাদের আপ্যায়নে একবার মেয়ে দেখার পর আর কেউ দ্বিতীয়বার ফিরে আসার তেমন নজির নেই। তিক্ত রাসেল পরিবার মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রাঙাদিয়া গেরামে তার মেয়ের সমবয়সী আর কোনো মেয়ে অবিবাহিত নেই। গেরামের মানুষ পনের-ষোলো বছর বয়সে মেয়ে বিয়ে দিতে না পারলে নিজের জন্য কলঙ্ক মনে করে। বাল্যবিবাহ যদিও এখন তেমন একটা হয় না, তবুও। তিক্ত রাসেল লম্বা জোব্বা পরেন। মসজিদের খতিব। তার ওয়াজ শোনার মতো একাগ্র মুসল্লি তেমন একটা নেই। তবু জুমা পড়তে যেতে হয় বলে সবাই মাথা নিচু করে হুজুরের বয়ান শুনে। তিক্ত রাসেলকে সবাই শ্রদ্ধা না করলেও সমীহ করে চলে।
তিক্ত রাসেলের বউয়ের নাম জ্যোৎস্না আমিন। ভাগ্যদোষে কারো সাথে কথা কাটাকাটি হলে প্রাচীন আরব্য গোত্রের মতো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাতেই চলে যায়। ঝগড়া আর থামে না। এ ব্যাপারে জ্যোৎস্নার খ্যাতি কম না। এলাকায় তার পরিচিতি ঝগড়াওয়ালি জ্যোৎস্না নামে। তবু তার অহংকারের শেষ নেই। সে ভদ্দর ফ্যামিলির মেয়ে বলে কথা।
মেয়ের বিবাহ হয়েছিল পার্শ্ববর্তী থানায়। ওরা তেমন একটা খোঁজখবর না নিয়ে ভদ্দর ফ্যামিলির মেয়ে দেখে দ্রুত নিয়ে যায়। কবির সাহেবের বিয়েতে তেমন একটা মত ছিল না। বাবার কথা রাখতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেন। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী সুখেই দিনাতিপাত করে আসছিল। এর মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে বেশ কয়েকবার গিয়েছিল। তখন আপ্যায়নে ত্রুটি ছিল না। কবির সাহেব শান্তশিষ্ট, নম্রভদ্র মানুষ। দুরবিন দিয়েও তেমন একটা দোষত্রুটি খুঁজে পাওয়া ভার।
শাশুড়ি জ্যোৎস্না বেগম অনেকদিন ধরে চাচ্ছিল তার মেয়ে তার পাশে ঘর করে তার ওখানেই বসতি করুক। কবির সাহেব আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। ঘর জামাই থাকাকে কখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় দেননি। তখন থেকে জ্যোৎস্না বেগমের সাথে তার দ্বন্দ্বের সূচনা। দু-এক বছর শ্বশুরবাড়ির উঠান মাড়াননি। কবির সাহেবের তিন সন্তান। ছোটোটা ৪ মাসের। এর মধ্যে তার বউ আকলিমা অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখিয়ে আনেন। আকলিমার মা প্রীতি খুব বেশি। তাই বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় নাইয়র করতে, দু-সপ্তাহ থাকবে। কবির সাহেব বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফেরার সময় রাতে যাবে। পরদিন তারা চলে আসবে। কথা ছিল এ রকম। ফলমূল, বউয়ের জন্য ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে রাত দশটায় শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হন কবির সাহেব।
রান্না করা হয়েছিল বেশ কয়েক ধরনের। ডাইনিং টেবিলে খাবারগুলো থরে থরে সাজানো। ক্ষুধার্ত কবির গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছিলেন। এর মাঝে জ্যোৎস্না বেগম এসে বলেন, আমার মেয়ে আর যাবে না। আকলিমাকে শিকল দিয়ে খাটে বন্দি করে রাখা হয়। হুংকার দিয়ে জ্যোৎস্না বলে ওঠে, খানকির পোয়ারে বওত চাইইয়্যি, আঁর হথা ন উওনে। আর ঐই তো নয়।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন নির্জন রাতে ছোটো ছেলেমেয়েদের বের করে দিয়ে দ্বারে কপাট লাগিয়ে দেয় জ্যোৎস্না বেগম। যদিও সে রাতের রান্নার স্বাদ ছিল ব্যাপক রসালো। কিন্ত মধুর স্বাদের তিক্ত আপ্যায়নে কবির সাহেব নিষ্পাপ শিশুদের নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তখন থেকে প্রবাদ বাক্য হয় শ্বশুরবাড়ি মধুর হাঁড়ি। কিন্তু উনিশ-বিশে মধুর স্বাদে তিক্ত আপ্যায়নও হয়।