খালেদ হামিদী »
আমার প্রথম বই, কাব্যগ্রন্থ, আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো, প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে যিনি একটি কবিতায় বলেন: ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন/তার বক্ষে বেদনা অপার।’ প্রত্যেক প্রকৃত কবিই কষ্ট-কল্পিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা রচনার মুহূর্তে এই অলৌকিক কিংবা অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করেন। আর, প্রথম গ্রন্থিত হবার কালে? নিশ্চয়ই কবি মাত্রই নানা মাত্রায় উচ্ছ্বসিত হন। বিশেষ করে, আমার ক্ষেত্রে তা ছিল এডভেঞ্চারাস কিংবা প্রায় অভিযানতুল্য। এক অপরাহ্নে বন্ধু শাহজাহান আড্ডার এক ফাঁকে হঠাৎ বলে ওঠে: ‘বড় বড় পত্রিকায় শুধু কবিতা বেরুলে হবে? বই বের না করলে তো তোমার মূল্যায়ন হবে না।’ এ-কথায় আমার একপ্রকার বোধোদয় হলেও বলে উঠি: ‘আমার তো বই প্রকাশের টাকা নেই!’ প্রকাশক খোঁজার কথাও হয়তো মাথায় আসেনি। তখন সম্ভবত ১৯৯৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। বাল্যবন্ধু সারোয়ারসহ আমার পৈতৃক বাড়ির নিকটবর্তী মোড়ের চায়ের দোকানে যাওয়ার সময়, শাহজাহানের সেই কথায়, আমরা তিনজনই দাঁড়িয়ে পড়ি।
তখনই সিদ্ধান্ত হয়, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের উত্তর-পূর্ব কোনায়, আমাদের সেই আড্ডাস্থল রেস্টুরেন্টটার বিপরীতে, রাইজ অফসেট প্রিন্টার্সে বই ছাপানো হবে। ছাপাখানাটিতে শাহজাহানের অফিসের কাজ হয়। কিন্তু এডভেঞ্চারের অনুভূতি হয় শুরুতে, কবিতা নির্বাচনের সময়। এরপর এনজিও-কর্মী নির্মল কান্তি সাহা, তাঁর মনিব কবি খুরশীদ আনোয়ারের নির্দেশে, আমার বই কম্পোজ করেন। তাঁদের জামাল খান বাইলেনের অফিসে কতবার যে গিয়েছি তার হিসেব নেই। আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় দুই বন্ধু শাহজাহান ও মহিউদ্দিন এবং বন্ধুপ্রতিম সহকর্মী রাব্বান (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী)। শেষোক্ত জনের একটা কথা ভুলতে পারি না: “আমি হাত না বাড়িয়ে তাকিয়ে থেকে ইতিহাসের অভিসম্পাত নিতে চাই না।” আজকের হিসাবে তাঁদের দেওয়া (সম্প্রদান) সেই টাকার অঙ্ক ছোট হলেও মোট খরচের প্রায় অর্ধেক সংকুলান হয়েছিল। বাকি টাকা অনেক সময় নিয়ে কত কিস্তিতে যে প্রেসকে পরিশোধ করেছি মনে নেই। মুদ্রক ভদ্রলোক কোনোদিন রুষ্ট হননি। প্রতিবারই হাসিমুখে বিনীত থেকেছেন। তাঁর নাম আর মনে নেই। সেই প্রেসটিও নেই।
বই প্রকাশের দিন সন্ধ্যায় ছাপাখানার সামনে অসম্ভব আনন্দিত-উচ্ছ্বসিত হয় অনুজপ্রতিম বন্ধু (চবি-র চারুকলা বিভাগের তৎকালীন ছাত্র, বর্তমানে চলচ্চিত্রকার, ঢাকাবাসী) মঈন হাসান ধ্রুব। এর আগে ওর অনুরোধে ঢালী আল মামুন আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রচ্ছদ এঁকে দেন। পরে সম্মানী নিতে অসম্মতি জানিয়ে আমাকে তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ করে তোলেন। প্রচ্ছদের নামলিপির কৃতিত্ব খালিদ আহসানের। তিনিও কিছুই নেননি। পরে দুটি বড়ো পত্রিকায় বইটি মূল্যায়িত হয়।
কিন্তু আমার প্রথম বই আজ নিয়ে আসে অপার বেদনা। প্রকাশের দুই/তিন বছর পরে কবিতাবিরোধী কেউ আমার অজান্তে বইটির শতাধিক কপি সের দরে বিক্রি করে দেন যেগুলো পরে ফুটপাতে দেখতে পান আমার একজন সহকর্মী! এদিকে লাং ক্যান্সার ক্ষমা করেনি শাহজাহানকে। ২০১৩ সালে তাঁকে হারাই। তবুও নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান মনে হয় এ-জন্য যে প্রথম বই প্রকাশের জন্য পাবলো নেরুদার মতো আমাকে ঘরের আসবাব বিক্রি করতে হয়নি। শুধু দেখতে পাই দুই ভিন্ন দৃশ্য: আমরা পড়ন্ত বেলায় নিথর শাহজাহানকে গোরস্তানে নিয়ে যাচ্ছি আর প্রথম বইয়ের বস্তা কাঁধ থেকে পিঠে ঝুলিয়ে গভীর রাতে প্রিন্টিং প্রেস থেকে একা বাড়ি ফিরছেন নেরুদা।
আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৯৯৯; প্রকাশক: একান্তর প্রকাশনী; প্রচ্ছদ: ঢালী আল মামুন; মূল্য: ৪৫ টাকা