মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম
আধুনিকতা একটি আন্দোলন, যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা দুনিয়ায় সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান ঘটে। এটি প্রতিটি মানুষের আত্মসচেতনাকে প্রাধান্য দেয়, যদিও মূলত এটি একটি চিন্তাকাঠামো।
মানব সভ্যতা মানুষের জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, নানা বিষয়ের ওপর যখন কোন কবির উপলব্ধি আধুনিক মননে ও আদলে হয় তখন সমাজ পরিবর্তনের মানসে পাঠককে আন্দোলিত করে এবং নিজেই অনুপ্রাণিত হয়। তখন তা আধুনিক কবিতার রূপলাভ করে।
অনেকের মতে কবিতা শব্দসমবায়ে রচিত হয়, জীবননান্দ দাশ-এর মতে উপমাই কবিতা। অন্যদিকে সেই কবিতা অনেকের মতে আবার ছন্দ মানে না। সুন্দর সুন্দর শব্দ যখন কবির হৃদয়ে ঘুমিয়ে থাকা ভাবকে ছন্দে রূপ দেয় এবং কবি ও পাঠককে জাগিয়ে তোলে সেইটিই কবিতা। আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিক শব্দটি ‘অধুনা’শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ সম্প্রতি বা আজকাল।
আধুনিক কবিতার উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান বিষয়কে যথাবিহিত শব্দবিন্যাসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থাপন করা। যেখানে কবির সৃজনশীল রচনা সময়ের দাবিতে, সমকালের আহবানে, মানব চেতনায় ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
আধুনিক কবিতায় ছন্দের কথা আসলে অনেকে বিরক্তিবোধ করেন। যদিও ছন্দের বিষযটি ব্যাপক। প্রত্যেক সার্থক কবিতা কোন না কোন ছন্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। মোদ্দাকথা, কবিতা যেভাবে লেখা হোক না কেন, তার মধ্যে একটা ঝোঁক বা তরঙ্গের উপস্থিতি থাকতে হবে। যদি কোন কবিতা ধ্বনিগুলোর সমন্বয়ে অর্থনির্ভর ছন্দস্পন্দনে তরঙ্গায়িত হয় তখন তা কবিতা হয়ে উঠতে পারে। কেননা একটি যথার্থ কবিতার মাঝে কোন না কোনভাবে ছন্দময়তা থাকে। কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ দিয়ে হয় না। ছন্দ ও অর্থের সমন্বয়ে কবিতা হয়ে থাকে। ছন্দ যদিও কবির একান্ত নিজের, যা কাব্যরসে ভরপুর, শুনতে মধুর এক ধরনের বিন্যাস।
যখন কোন কবিতায় কোন কবি ধ্বনিগুলোকে সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বিন্যস্ত করে এক ধরনের সুষমা দান করেন তাতে পাঠক এক ধরনের ধ্বনিমাধুর্য উপভোগ করে। তখন ঐ বিন্যাসই ছন্দ হয়ে ওঠে। কবিতায় শব্দসুষমা না থাকলে যতই কাঠামোবদ্ধ ছন্দ প্রয়োগ করা হোক, তা কবিতা হয় না। প্রচলিত যে ছন্দের কথা বলা হয়, তা না থাকলে যে কবিতা হবে না, তা ঠিক নয়। প্রচলিত ছন্দের যে আবেদন তা আধুনিক কবিতায় নেই বললেই চলে। তবে ছড়া ও পদ্যের ক্ষেত্রে তার আবেদন শতভাগ রয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে অনেক বিখ্যাত কবিতা আছে, যেখানে প্রচলিত ছন্দের কাঠামো অনুসরণ করা হয়নি। ছন্দ দুভাগে সৃষ্টি হয়, একটি শব্দগত, অন্যটি ভাবগত। বর্তমানে বিখ্যাত কবিতাগুলো অর্থ ও ভাবনির্ভর। শুধু ছন্দ কখনও কবিতা হতে পারে না। ছন্দ কবিতার উপকরণ মাত্র। একজন ছড়াকার ছন্দের বারান্দায় হাঁটেন আর একজন কবি হাঁটেন ভাবের বারান্দায়। একজন কবির কাছে ভাব আগে, যেখানে তার ভাবের গভীরতায় কবিতা সৃষ্টি হয়। আজকের প্রেক্ষাপটে গদ্যছন্দ অনেকের নিকট গৃহীত নয়।
অন্ত্যমিল যুক্ত কবিতা না হলে ঐ কবিকে ছন্দে আনাড়ি কবি বলা হয়। আসলে আধুনিক কবিতা হচ্ছে মুক্তক কবিতা। এখানে ছন্দের চেয়ে বেশি জরুরি কবিতার ভাব। ছন্দের চেয়ে আধুনিক কবিতায় কবিরা তাদের ব্যক্তিগত বোধকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন।
কবিতা মূলত একটি শিল্প। যেখানে কবিরা আবেগ ও কল্পনা দিয়ে নিজস্ব ভুবন তৈরি করেন। শুধু ভাষা নয়, ভাষার বাহনে চেপে কবি পাঠককে নিয়ে যান অদেখা-অধরা কোন অভিজ্ঞতার অন্তরালে। সেক্ষেত্রে প্রচলিত ছন্দ ছাড়া আধুনিক কবিতা পাঠককে ও পাঠকমনকে অনুপ্রাণিত করে।
আধুনিক কবিতায় ছন্দ থাকতে পারে। আবার ছন্দকে প্রভুজ্ঞান করে বর্তমান ধারাকে অস্বীকার করা ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, ছন্দ জানা ভালো, তবে এর দাসত্ব করা ঠিক নয়। কেউ কেউ বলেন, অন্ত্যমিলের অনুপ্রাস হচ্ছে ছন্দ। যদি কোন কবিতাপাঠ করতে গিয়ে পাঠক ভাষার সাবলীলতা, গতিবেগসহ বিনা বাধায় হোঁচট না খেয়ে গন্তব্যে পোঁছাতে পারেন, তা হচ্ছে কবিতা।
কবিতা যাতে বখাটে না হয়, সেই জন্য ছন্দের প্রয়োজন রয়েছে এবং যা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, হতে পারে। কবিগুরুর হাতে যা অনেকটা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। মূলত আধুনিক কবিতা সাহিত্যের অন্যতম একটি বাহন। আধুনিক কবিতায় কবির ভাবনা হচ্ছে চিন্তার বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রকাশ। গদ্যে বা আধুনিক কবিতায় ‘সাধারণত যা বলে তাই বলে’ আর পদ্য যা বলে তার চেয়ে বোঝায় বেশি। যেমন, ঘন বরষা। গগনে মেঘ গর্জন করে। অন্যদিকে ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা।’ গদ্য বা আধুনিক কবিতা বুঝায়, সকলকে জানান দেয়। অন্যদিকে পদ্য বা ছন্দকবিতা পাঠককে অনুপ্রাণিত করে। অনেকে বলেন, আধুনিক বা গদ্যকবিতার জম্ম হয় মস্তিষ্কে, আর পদ্যের জম্ম হয় হৃদয়ে। গদ্য হাঁটে আর পদ্য উড়ে। এর মধ্যে একটি জ্ঞান অন্যটি প্রজ্ঞা।
মূলত উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত অর্থে আধুনিকতার পূর্বাভাস দেখা যায়। কালক্রমে রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করেছিলেন।
মুক্তক রীতি স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ মধুসূুদনের নিকট ফিরে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মধুসূনের মত একটি ধ্রুপদি পৃথিবী গড়ে তুলেছিলেন। কবি মাইকেল মধুসুধন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মসংবরণের দুটো দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাইকেল মধুসূদনকে গ্রহণ করেছিলেন। যেমন- এই বর মাগি শেষবারে, জ্যোতির্ময় কর বঙ্গে-ভারতরতনে। অন্যদিকে, দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি, লজ্জা দিও না।
বাংলা সাহিত্যে মূলত আধুনিক যুগের প্রথমপর্ব নির্মাণ করেন পাদ্রি আর সংস্কৃত প-িতেরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্যে দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয়। দ্বিতীয়পর্বে আগমন ঘটে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল বাঙালি সাহিত্যিকদের। তৃতীয়পর্বের ব্যাপ্তি কম হলেও গোটা সময়ে রবীন্দ্রনাথ [১৮৬১-১৯৪১] প্রাধান্য বিস্তার করেন।
এরপর রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে কবিতা ও সাহিত্যের ভাবধারার পরিবর্তন ঘটে। ফলে বাংলা সাহিত্য হয়ে যায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গনির্ভর ।
১৯৪৭ থেকে অদ্যাবধি যে সময়, সেটিকে বাংলাদেশপর্ব বলা চলে। যদিও সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা সুনির্দিষ্ট তারিখ, সন মেনে হয় না। আমরা জানি, কালবিচারে বাংলা সাহিত্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০) ও আধুনিক (১৮০০ …) । আধুনিক যুগের শুরু ১৮০০ থেকে হলেও মূলত ১৯০০ থেকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। তখন থেকে বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষা সমাদৃত হতে থাকে। এই সময়কে নবজাগরণের যুগও বলা হয়ে থাকে। এই সময়ে বাঙালি প্রতিভার সর্বমুখী বিকাশ ঘটে।
একই সময়ে শক্তিশালী সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং গদ্যসাহিত্যসহ আধুনিক কবিতার বিকাশ ঘটে। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আধুনিক কবি বলা হয়ে থাকে। তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ও ‘চতুর্দশপদী’ কবিতা লিখে বিখ্যাত হন। চর্যাপদ বাংলা হলেও আমরা জানি, চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য হচ্ছে পদ্যসাহিত্য।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মূলত বাংলা কবিতার ইতিহাস। সাধারণ মানুষের মতে, কবিতা মানেই আধুনিক কবিতা। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি অন্ত্যমিলের হলেও তিনি হাওয়ার রাত, আমি যদি হতাম-এর মতো গদ্যকবিতাও রচনা করেছেন। কবিতার পরিধি, কৌশল, ছন্দ ও আবৃত্তির কারণে দশকে দশকে বদলে গেছে কবিতা। রবীন্দ্রনাথের জীবিত অবস্থায় ত্রিশের কবিরা কবিতাকে বদলে দিয়েছেন। প্রতিটি দশকে দশকে কবিতার উন্নতি হয়েছে। ষাট-সত্তর-আশি’র দশক বা এর পরবর্তী কবিরা কবিতায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন। কবিতায় এনেছেন নতুনত্ব।