ড. আনোয়ারা আলম»
মানুষ কখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়? এর কারণ ব্যাখ্যায় ফরাসি সমাজতত্ত্ববিধ ডুর্খেইম বলেন -‘যখন সমাজের সাথে মানুষ নিবিড়ভাবে একাত্মতা অনুভব করে না,তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।’ অর্থাৎ মানুষ নিজেকে যখন নিঃসঙ্গ বা অসহায় মনে করে- তখন আত্মহত্যা করে আর তাই সমাজে বিবাহিতদের চাইতে অবিবাহিতের আত্মত্যার হার বেশি। ‘যদিও তিনি এও বলেছেন ‘কখনো সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে বা কখনো আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে মূল্যবোধহীন ও অস্বস্তিকর যখন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে তখন মানুষ আত্মহত্যা করে।’
আত্মহত্যার বিভিন্ন রূপ। কখনো সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে বা আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে মূল্যবোধহীন ও অস্বস্তিকর অবস্থা যখন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে তখনো মানুষ আত্মহত্যা করে ’।
আত্মহত্যার বিভিন্ন রূপ আমরা দেখি – কখনো দারিদ্র্যের যন্ত্রণা, কখনো নিরাপত্তাহীনতা,কখনো কোন কারণে অপমানবোধ, কখনো দাম্পত্য জীবনে তীব্র অশান্তি, কখনো কখনো মনের কোন ব্যাপার ইত্যাদির কারণে মানুষ নিজেকে শেষ করে দেয়। একটি কথা বলতে দ্বিধা নেই, জীবন বড়ো নিষ্ঠুর, কখনো কখনো জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষ আত্মহত্যা করে, যেজন্য ধর্মে বলা হয়েছে আত্মহত্যা মহাপাপ।
তবে নারী কিন্তু একেবারে অপারগ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কখনো পরিবার, কখনো সমাজ কখনো পরিস্থিতি কখনো ধর্মের অপব্যবহার তাকে বাধ্য করে। আত্মহত্যা কেন করেছিলেন ক্লিওপেট্রা! ঐতিহাসিক এই নারীর বুদ্ধি ছিল প্রখর,ভাষা জানতেন কমপক্ষে সাতটি। বিশ বছর একটানা শাসন করেছেন, রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন বিশ বছর একটানা শাসন করেছেন। বোকা বানাতে পারতেন পুরুষদের। তবে কেন আত্মহত্যা? মতভেদ আছে অনেক। তবে সম্ভবত এক ধরনের উন্নাসিকতা ও দম্ভের কারণে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া,একই সাথে ক্ষমতা হারানো এবং প্রেমিক এন্টিনিওর সাথে বিচ্ছেদ। এই যন্ত্রণা এতোটা তীব্র ছিল বিষাক্ত সাপের দংশন নিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
কিন্তু সাধারণ নারীরা কেন এ পথে?
ইদানিং কিশোরীরা ও অনেকে এ পথে পরীক্ষার প্রবেশ পত্র হারিয়ে বা প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায় বা তুচ্ছ কোন বিষয়ে। যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত। অনেকে ইভটিজিং এর কারণেও।
কৈশোরকাল সবচেয়ে সুন্দর সময়। মানুষের চোখে থাকে স্বপ্ন, কল্পনা, রোমাঞ্চ ও আশা। আবার এ কারণে ভুলও করে অনেকে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে অভিভাবকদের ইঁদুর দৌড়ে বা স্বপ্নভঙ্গের কারণে তাদের বিকশিত হওয়া ছন্দপতনে চরম হতাশায় আত্মহত্যা। ইদানিং দাম্পত্য জটিলতা ও নানাভাবে বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এবং নারী অনেক ক্ষেত্রে সন্তানসহ আত্মহত্যা করছেন।
একসময়ে সতীদাহ প্রথার কারণে নারীর সহমৃত্যু এক ধরনের আত্মহত্যা। আবার অনেকে বৈধব্যের জীবন বিড়ম্বনা থেকে নিস্কৃৃতি পাওয়ার নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়তেন আগুনে।
১৯৭১ সালে পাকসেনাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে কতো কতো নারী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। দুর্ভাগ্য এই যে পরিবারের লোকজন এতে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যাঁর স্বপ্ন ছিল অনেক এবং মেধাবীও ছিল। পাকিরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আবার ফেরত দেওয়ার পরে পারিবারিক অশান্তির কারণে আত্মহত্যা করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের বীরাঙ্গনা খেতাবেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। পরবর্তীতে একজন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কারণে তাঁরা এখন মুক্তিযোদ্ধা। যদিও একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের মতো এদের অনেকে মারা গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন।
একুশ শতকে ও মুক্তি মিলেনি অনেক অনেক নারীর। এখনো সমাজে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে নারীসমাজ বৈষম্যের শেকলে বন্দি। তাই লোকচক্ষুর অন্তরালে অনেক নারী হারিয়ে যায়। আর অন্যতম কারণ যৌতুক প্রথা।
জীবন তো একটাই। তাই নারী বা কিশোরীর জীবন যাতে অকালে ঝরে না পড়ে সেক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা পরিবারের। নারীর ভেতরে আত্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ, দৃঢ়তা সবকিছু মিলিয়ে সে যেন মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে এ দায়িত্ব পরিবারের। আর বয়ঃসন্ধিক্ষণে সে যেন ভুল পথে না যায় সে লক্ষ্যে মা ও বাবাকে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে।
এছাড়াও নারীর সামাজিক নিরাপত্তা দরকার। নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা, তার মতামতের অধিকার, নারী ও পুরুষে বৈষম্য নিরসন, নারী স্বার্থের অনুকূল প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা আমদানি করা বা স্বার্থবিরোধী প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এসব বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারকে। যে নারী সৃষ্টির আদিকাল থেকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃজন, রক্ষণ, উন্নয়ন সকল স্তরে অপরিহার্য দায়িত্ব পালন করে থাকে, সভ্যতার এ চরম সন্ধিক্ষণে নারী বা কিশোরীর অকালে মৃত্যু তথা আত্মহত্যার মতো ঘৃণিত পথ যেন বেছে নিতে বাধ্য না হয় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।