কামরুল হাসান বাদল »
মৃত্যুর দু-তিন বছর আগে, সম্ভবত দশ কি এগারো সালের দিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। অনেকেরই জানা থাকার কথা প্রখ্যাত এই চিকিৎসক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসকও ছিলেন। জানার আগ্রহ ছিল খুব কাছ থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে কেমন দেখেছিলেন। উত্তরে তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে গলব্লাডার স্টোন অপসারণের জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে গিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে ডা. ইসলামও সঙ্গে ছিলেন। সফল অপারেশনের পর বঙ্গবন্ধুকে কেবিনে আনা হয়েছে। তাঁর জ্ঞান তখনও ফেরেনি। কেবিনে সবাই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। একসময় ধীরে ধীরে চোখ খুললেন বঙ্গবন্ধু। বিছানার পাশে বসে তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা ডা. ইসলামকে প্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হলো, বাংলাদেশের কী খবর? উত্তর শোনার আগেই তিনি চোখ মুদ্রিত করলেন। আবার ফিরে গেলেন তন্দ্রায়। কিছু সময় পর আবার চোখ খুললেন। এবার রুমের চারপাশে চোখ বোলালেন। রুমে তখন কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা এখানে কী করছো? দেশে তোমাদের কোনো কাজ নেই? এখানে থেকে খরচ বাড়াচ্ছো কেন, দেশে ফিরে যাও।’
ডা. নুরুল ইসলাম আমাকে বললেন, ‘আমার দীর্ঘ চিকিৎসা পেশায় এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি। এটি একটি মিরাকল। অ্যানেস্থেসিয়ার প্রভাব কাটে ধীরে ধীরে। জ্ঞান ফিরে এলেও প্রথমাবস্থায় রোগী থাকেন আধো ঘুম আধো জাগরণে। এ সময়ে কোনো রোগী বানিয়ে কিছু বলতে পারেন না। রোগীর মনোজগতে যে বিষয় গভীরভাবে প্রোথিত থাকে অনেক সময় তাই প্রকাশ করেন রোগী।
একজন মানুষ দেশ ও দেশের মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এমন করতে পারে তা ভেবে আজও আমি বিস্মিত হই।’
এই একটি ঘটনা দিয়েও পরিমাপ করা যায় দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা কতটা আন্তরিক ও গভীর ছিল। এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র হতো না। স্বাধীনতা কাকে বলে তা অনুধাবনের সুযোগও পেত না। পাপ-পুণ্য বোঝাতে যদি ভালো আর মন্দ কাজকে বোঝায় তাহলে বলতে হয় বাঙালির হাজার বছরের পুণ্যের ফল শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতার জন্ম হওয়া। প্রতিটি জাতিই কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম দেয়। এরাই জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন, নিজ মেধা ও তেজস্বিতার গুণে জাতিকে মুক্ত করেন, জাতির ভাগ্য বদলে দেন, জাতিকে মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেন। এঁদের কেউ রাজনীতির ক্ষেত্রে, কেউ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে জাতিকে সমৃদ্ধ করেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াসিংটন, উইনস্টন চার্চিল, মাও সে তুং, মহামতি লেনিন, ফিদেল কাস্ত্রো, চার্লস দি গল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চে গুয়েভারা, আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন ম্যান্ডেলা এঁরা আজ শুধু নিজ দেশেই নয় বিশ্বের সবদেশেই সম্মানীয়, পূজনীয়।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও আজ উচ্চারিত হয় এই বিশ্ববরেণ্য নেতাদের নামের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার তিনি জন্মেছিলেন একটি পরাধীন দেশে। ফলে তাঁকে দেশকে স্বাধীন করার মহৎ কাজের দায়িত্বটি পালন করতে হয়েছিল এবং সে কাজটি তিনি সম্পাদন করেছিলেন খুব অল্প সময়ে। এত অল্পদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে একটি দেশকে স্বাধীন করার নজিরও বিশ্বে নেই। তিনি শুধু একজন জাতীয়তাবাদী নেতাই নন, একই সঙ্গে তিনি একজন বিপ্লবীও।
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ শুধু আজ বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে যেখানেই মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার শিকার হচ্ছে সেখানেই মুক্তির বারতা নিয়ে আসবে। কারণ মানুষের সার্বিক মুক্তিই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
বিশ্বের অনেক নেতাই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন একমাত্র নেতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই যতদিন বিশ্ব জুড়ে মানুষের মুক্তির আন্দোলন থাকবে, মুক্তির লড়াই থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। মানবতার মুক্তিযুদ্ধে দেদীপ্যমান হয়ে থাকবেন।