ওবায়দুল সমীর »
আজলান ছিল এক কৌতূহলী কিশোর। ছোটবেলা থেকেই সে প্রকৃতি আর প্রাণীদের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করত। স্কুলের পর প্রায়ই সে গ্রামের পাশের নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত। পাখিদের ডাক শুনত, আর মাছ ধরতে থাকা বকগুলোকে দেখত। মাছের আশায় একপায়ে দাঁড়ানো ধ্যানমগ্ন বক দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত। একসাথে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া বকগুলো দেখে আনন্দে ওর মনটা নেচে ওঠে। মানুষ কতটা নিঠুর হলে এদের হত্যা করতে পারে! এক শিকারিকে বেশকিছু বককে চোখ বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে দেখে আজলানের বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠেছিল। বয়স কম বলে কিছু বলার সাহস পায়নি।
একদিন বিকেলে আজলান নদীর ধারে বসেছিল। হঠাৎ সে কচুরিপানার ভেতর থেকে একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেল। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে, একটা ছোট্ট বুনোহাঁস জালের ফাঁদে আটকা পড়েছে। পাখিটা ছটফট করছিল, কিন্তু কিছুতেই মুক্ত হতে পারছিল না।
আজলান দেরি না করে পাখিটিকে সাহায্য করতে গেল। খুব সাবধানে সে জালের গিঁটগুলো খুলে দিল। মুক্তি পেয়ে বুনোহাঁসটি প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ডানা ঝাপটিয়ে পানির ওপরে ভেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর সে আজলানের দিকে তাকাল, যেন কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। আজলান মনে মনে হাসল।
এরপর থেকে আজলান প্রায়ই নদীর ধারে গিয়ে বুনোহাঁসটিকে দেখত। সে বুঝতে পারল, হাঁসটি তাকে চিনতে শুরু করেছে। প্রতিদিন বিকেলে আজলান যখন নদীর ধারে যেত, হাঁসটি তার কাছাকাছি চলে আসত। পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরত আর মাঝে মাঝে আজলানের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন আনন্দ প্রকাশ করত। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
আজলান হাঁসের ডুব-সাঁতার আর উচ্ছ্বাস দেখে বেশ মুগ্ধ হয়। সে নিজে থেকেই হাঁসটির কাছে গিয়ে বলে,
‘তুমি কি এখানে সব সময় থাকো?”
বুনোহাঁস উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি নদীর পাশেই থাকি। এই জায়গাটি আমার বাড়ি।’
আজলান জানতে চায়, ‘তুমি কি কখনো অন্য জায়গায় যাও না?’
হাঁস হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি অন্য জায়গায়ও যাই, কিন্তু এই জায়গাটি আমার প্রিয়। আমি মুক্তভাবে আকাশে উড়তে পারি এবং নদীর পানি পান করতে পারি।’
আজলান ভাবছিল, ‘আমি যদি এই বুনোহাঁসের মতো হতাম। যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারতাম, তাহলে আমার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করাটা সহজ হতো।’
বুনোহাঁস বুঝতে পারে আজলানের মনের ইচ্ছে।
হাঁস তাকে বলে, ‘আজলান, মনে রেখো, আমরা প্রত্যেকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীন। তবে সেই স্বাধীনতার সাথে আসে দায়িত্ব। যেমন আমার দায়িত্ব নদীর পানি পান করা, খাদ্য সংগ্রহ করা এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। তেমনি তোমার দায়িত্ব পড়াশোনা করে জীবনে সফল হওয়া। তবেই তুমি তোমার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে।’
আজলান হাঁসের কথা মনে রেখে প্রতিদিন নদীর ধারে আসে। হাঁস একাগ্রচিত্তে খাবার সংগ্রহ করে, ডুব-সাঁতার খেলে আবার সময় মতো দূরে উড়ে যায়। তার কোন ক্লান্তি নেই। তার লক্ষ্যে সে অবিচল। আজলান হাঁসের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে।
হাঁস তাকে বলে, ‘একদিন তুমি অনেক বড় হবে, তবে কখনো স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করো।’
আজলান ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে পরিশ্রম ও অধ্যবসায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বুনোহাঁসের সাথে বন্ধুত্ব আজলানকে অনুপ্রাণিত করে, এবং সে তার জীবনের লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রতিদিন নিরলস পরিশ্রম করতে থাকে।
একদিন আজলান স্কুলে প্রথমস্থান অধিকার করে এবং সবাই তার প্রশংসা করে। আজলান তখন সেই বুনোহাঁসের কথা মনে করে, যে তাকে শিখিয়েছে জীবনে স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বের সম্পর্কটা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে।