আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে না

ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত

সুপ্রভাত ডেস্ক »

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসা বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে না; ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা এমনটাই বলেছেন। একইসাথে সুদহার কমানো, স্থানীয় বাজারে চাহিদা সৃষ্টি, রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

শনিবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিল কার্যালয়ে আয়োজিত ‘কারেন্ট স্টেট অব দ্য ইকোনমি অ্যান্ড আউটলুক অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। বক্তব্য দেন শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ।

ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসনিক কার্যক্রম, ব্যাংক ঋণের সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ সামগ্রিকভাবে যে টানাপোড়েন চলছে তাতে অর্থনীতির ছোট হয়ে আসবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, মূল্যস্ফীতিও কমবে না। এজন্য একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ দরকার। যেখানে বিনিয়োগ হবে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারবেন। সেটির প্রধানত সরকারকেই করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের কেউ পালন করতে হবে।’

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে কার্যকরী সুদহার ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে আগামী মার্চ থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ না করলেই সেই প্রতিষ্ঠান খেলাপি হবে।’

তিনি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির উদ্যোগ চান। একইসাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার ও সুদহার কমানোর দ্রুত পদক্ষেপ আশা করেন। ‘

বিকেএমইএর সভাপতি মোঃ হাতেম বলেন, ‘ইন্ধন ছাড়া কোন শ্রমিক অসন্তোষ হয় না। ৪০টি খাতে মজুরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু একমাত্র তৈরি পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে। অন্য খাতগুলোতে কি মূল্য স্মৃতির প্রভাব নেই?”

তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের সুদ হারের কারণে অনেক কিছু সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ না করলেই খেলাপি করার যে নিয়ম করা হয়েছে, তাতে ৯০% ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়বেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এই পলিসি নিলো সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। এতে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে ধরা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় সংকট গ্যাস সংকট। এর কারণে সময় মত উৎপাদন করা যাচ্ছে না, এক্সপোর্ট হচ্ছে না। বেশিরভাগ কারখানার বেতন দিতে অসুবিধা হচ্ছে।’

এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা ভীষন ইনসিকিউরড ফিল করছি। কালকে কী হবে, কী টেলিফোন আসবে এরকম দুশ্চিন্তায় থাকছেন ব্যবসায়ীরা। আশুলিয়া, গাজীপুরে শুধু ওয়ার্কার অসন্তোষ হয়েছে তা নয়। সেখানে অন্য বিষয়গুলো ছিল। সরকারকে এখন ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে হবে যে বাংলাদেশে ব্যবসা করার নিরাপদ।’

তিনি বলেন, ‘দেশে বর্তমানে ১৪-১৫ শতাংশ সুদহার ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্য। এসব ধরে বিশ্বের কোথাও কেউ ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে না। সবকিছু ফাইনাল করেও দুটো কোম্পানির এফডিআই আসছে না তারা ‘ওয়েট অ্যান্ড সী’ নীতিতে আছে।

তিনি বলেন, ‘শুধু রেমিটেন্স ও দাতা গোষ্ঠীর টাকা দিয়ে একটা দেশ চলতে পারে না। রপ্তানি আয় ও অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখতে হবে।’

প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না, এমন দাবিও করেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন পুরোপুরি কাজ করছে না। চাকরি থাকবে কি থাকবে না, নতুন করে আবার কী বের হয়ে আসে—এমন সব কারণে কাজ করতে চাচ্ছেন না অনেকে। ফলে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্মকর্তাদের বার্তা দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু প্রবাসী আয় এবং দাতাদের ঋণ ও সহায়তায় দেশ চলবে না। ব্যবসায়ীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁদের (ব্যবসায়ীদের) কথা বলার একটা জায়গা লাগবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

শিল্পাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কষ্টে আছি। আজকে আমার কারখানায় যেতে ভয় লাগে। ভয় লাগে এই জন্য যে আমি কী নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব? এভাবে ব্যবসায়ীরা যদি নিজেদের কারখানায় যেতে শঙ্কিত হন, তাহলে তাঁরা আগামী দিনে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে যাঁরা শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ উসকে দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান আহসান খান চৌধুরী। বলেন, ‘বর্তমানে যাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতায় অন্যায় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের শিক্ষা দিতে হবে। আমাদের দেশে কখনোই ‘‘দিতে হবে, দিতে হবে’’, ‘‘দাবি মানতে হবে’’—এমন সংস্কৃতি ছিল না। আমরা বিগত দিনে কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেছি। আমরা সেই সংস্কৃতি ফিরে পেতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলার উন্নতি একটি মৌলিক বিষয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী দিনে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।’

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে হবে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ব্যাংকের সুদ হার কমানোর জরুরি হয়ে পড়েছে।”

মাস্টার কার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদির কারণে শপিংমলে কেনাবেচা কমে গেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে জুলাইয়ে ৪০ ভাগ এবং আগস্টে ৩৫ ভাগ ডিজিটাল লেনদেন কমে যায়। সেপ্টেম্বরের সেটা কিছুটা বেড়েছে। তবে সাপ্লাইচেইন এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না যে কারণে মূল্য কমছে না।’