নিজস্ব প্রতিবেদক »
রমজানের শুরু থেকে হঠাৎ অস্থির হয়েছিল তরমুজ। এমনকি আড়তপর্যায়ে ১০০ টাকার তরমুজ ৩৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছিল ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তরমুজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা। এমনকি কৃষকদের থেকে কেনা ধরে বিক্রি করলেও কেউ কিনছেন না তরমুজ।
রোববার সকালে নগরীর অন্যতম ফলের আড়ত ফলমণ্ডি, স্টেশন রোড ও কোতোয়ালি ফিরিঙ্গী বাজার ফলের আড়ত ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশালের খামারবাড়ি, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, গৌরনদী থেকে ট্রাকে ট্রাকে তরমুজ এসেছে আড়তে। পর্যাপ্ত যোগান থাকলেও সে অনুযায়ী আড়তে ক্রেতার ভিড় নেই। অনেকটা অলস সময় পার করছেন আড়তদাররা।
অন্যান্য ফলের দিকে ক্রেতার আগ্রহ বাড়লেও চড়া হওয়া তরমুজের প্রতি ক্রেতাদের কোন আগ্রহই দেখা যায়নি। যার ফলে তরমুজ নিয়ে বিপাকে আছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, বিদেশি ফলের দাম বাড়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর আমদানি অনেকটা কমেছে। পাশাপাশি রমজানের শুরুতেই ক্রেতাদের চাহিদা বেড়েছে দেশীয় বড়ই, পেয়ারা, কমলা, আখ, তরমুজসহ অন্যান্য ফলের দিকে। কিন্তু রমজান ঘিরে হঠাৎ চড়া তরমুজের বাজার। এতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার ও কৃষি অধিদপ্তর পৃথক অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে আড়তপর্যায়ে কৃষকদের থেকে কেনা দরের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়তি বিক্রির প্রমাণও মেলে। যার কারণে কোতোয়ালির ফিরিঙ্গীবাজার, কাপ্তাই রাস্তার মাথার কামাল বাজার, স্টেশন রোড়ের বেশ কয়েকজন আড়তদারদেরও বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। এসব অভিযানের পরেও প্রশাসনের নির্দেশনাকে কোন ধরনের তোয়াক্কা না করে চড়া দরে বিক্রি করলে ক্রেতারা তরমুজের প্রতি অনেকটা আগ্রহ হারিয়েছেন।
স্টেশন রোডের আড়তে কথা হয় খুচরা ফল বিক্রেতা হোসেন আলীর সঙ্গে। চড়া দরের কারণে এ বছর তিনি নিজেই তরমুজ বিক্রি করছেন না বলে জানান।
তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘অন্যান্য বছর এদিনে যে তরমুজ বিক্রি করতাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা তা রমজানের শুরু থেকেই আড়তেই বিক্রি করছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
তাহলে আমরা বিক্রি করবো কত টাকা দিয়ে? তার মধ্যে প্রশাসন এসে বিরক্ত করে। তরমুজ কেনার রশিদ, মেমো দেখতে চায়। আমাদেরকে আড়তদারেরা কোন মেমো দেয় না। এত ঝামেলা নিতে চাই না। সে কারণে এবছর তরমুজ বিক্রি বন্ধ রেখে অন্য ফল বিক্রি করছি।’
একই কথা বলেন রেয়াজউদ্দিন বাজারের ফল বিক্রেতা মাসুম আক্তারও। তিনিও এবছর তরমুজ বিক্রি করছেন না। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর এদিনে তরমুজের চাহিদা ব্যাপক থাকে। কিন্তু এবছরও রমজান হওয়াতে ক্রেতাদের চাহিদা আছে কিন্তু চড়া দওে অনেকের কেনার সামর্থ্য নেই।’
রেয়াজউদ্দিন বাজারে তরমুজের দর শুনে বিমুখ হওয়া মো. আলাউদ্দিন নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘অন্যান্য বছর এদিনে যে তরমুজ বিক্রি করতো ৬০ থেকে ১০০ টাকায়, তা এবছর রমজানের শুরু থেকে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা। তাই এবার রমজানে হয়তো তরমুজ কেনা হবে না।’
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা কেনার প্রতি আগ্রহ হারায় তরমুজ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আড়তদারেরা।
স্টেশন রোডের ফল আড়তদার মো. আজিম বলেন, বরিশালের কৃষকদের কাছে আগের অর্ডার করা দুই ট্রাক তরমুজ শুক্রবার রাতে আসলেও শনিবার সারাদিন কোন ক্রেতা পাওয়া যায়নি। পচনশীল পণ্য হওয়াতেই তরমুজ নিয়ে চিন্তিত আছি। ক্রেতারা এভাবে বিমুখ হলে বড় লোকসানে পড়বো।
চড়া দরের অভিযোগের বিষয়ে এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, কৃষি অধিদপ্তরের নির্ধারিত দরে কৃষকরা তরমুজ বিক্রি করেননি। রমজানের শুরুতে আমাদের তরমুজ কিনতে হয়েছে ১৫০ টাকা বেশি। এখন হয়তো কৃষকরা কম দরে তরমুজ বাজারে ছাড়ছে। এখন দাম কমে যাবে। তাছাড়া এখন যেসব তরমুজ আছে তা সাইজভেদে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি করছি।
ফিরিঙ্গী বাজারের ফলমণ্ডি এলাকার নরসিংদী ফল বিতান এর মালিক আহমুদুর রহমান বলেন, এবছর ব্যবসায়ীরা বিদেশি ফলের আমদানি কম করেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রমজানে তরমুজ ও বেল বিক্রি করবো। যার জন্য ঝালকাটির চাষিদের কাছে আগাম অর্থ দিয়ে তরমুজ বুকিং করেছি। আমাদের বুকিং হয়েছিল প্রতি পিসে ১৪০ টাকা। কিন্তু এখন আড়তে খুচরা ক্রেতারা ৭০ থেকে ১০০ টাকার উপরে কিনছে না। ফলে বর্তমানে বড় লোকসান গুনতে হবে।
একই এলাকার তরমুজ পাইকারি ব্যবসায়ী মো. ফয়সাল বলেন, এক ট্রাক তরমুজ এসেছে আজ তিন দিন। মাত্র ২০০ পিস খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেছি। এমনকি কেনা দরের চেয়ে অর্ধেক দরে কিনতে চায় ক্রেতারা। এভাবে ক্রেতা বিমুখ হলে বড় লোকসানে পড়তে হবে।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবছর ৫ থেকে ৭ কেজি ও ওজনের তরমুজ প্রতি কৃষকদের উৎপাদন খরচ হয়েছে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। বরিশাল, ভোলার কৃষকরা আড়তদার পর্যায়ে তরমুজ বিক্রি করেছেন ৮৫ থেকে ১০০ টাকায় যা পরিবহন খরচসহ হিসেব করলে আড়ত পর্যায়ে প্রতি তরমুজে দাম পড়েছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা। কিন্তু সে ওজনের তরমুজ আড়তেই বিক্রি হয়েছে ৩৩০ টাকা।
ভোক্তা অধিকারের বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, কাপ্তাই কামাল বাজারে আড়তে দেখলাম কেনা দরের চেয়ে চড়া দরে তরমুজ বিক্রি করছে তরমুজ পাইকাররা। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছিল। পরবর্তী জরিমানাও করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, রমজানকে ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা তরমুজ চড়া দরে বিক্রি করছিলেন। এমনকি ১০০ টাকা কিনে প্রতি পিস ৩৩০ টাকা আড়তেই বিক্রি করেছিলেন। যার ফলে আড়তদারদের জরিমানাও করা হয়েছিল। বাজার তদারকিতে জেলা প্রশাসন অভিযান অব্যাহত রেখেছে।